বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার চেতনাবোধ থেকেই জাতিরজনক,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১সালে বাঙ্গালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। শিক্ষায়, চাকুরীতে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যখন নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিল বাংলার নিরীহ মানুষ, এক পর্যায়ে শোষণ, নিপীড়নে নিষ্পেষিত মানুষ জেগে ওঠেছিল এবং ঝাপিয়ে পড়েছিল ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামে।নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে অধিকার ফিরে পাওয়ার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সংগ্রামী জনতা। লক্ষ্য ছিল সর্বস্তরের মানুষদের নিয়ে সাম্য, সততা, মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি অহিংস রাষ্ট্র , স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা। কিন্তু সে দেশে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও কেন কোটার আঘাতে আহত মেধা,রক্তাক্ত ক্যাম্পাস? কেন শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস? হাতুড়ি পিটুনিতে চূর্ণ- বিচূর্ণ হাড়,রক্তাক্ত শরীর, পদদলিত শিক্ষা, পদপৃষ্ঠ তরুণ, লাঞ্ছিত তরুণী, এসব কেন? কাদের স্বার্থে? এ লজ্জা কার? অথচ বাঙ্গালিজাতির সকল গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের পেছনে অগ্রগামী ভূমিকা রয়েছে ছাত্রসমাজের। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের এগারো দফা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজয় অর্জনের পেছনে ছাত্রঐক্যের অপরিসীম ও দুঃসাহসী ভূমিকা অতুলনীয়। সেই ছাত্ররাই এখন অপরাপর ছাত্রের হাতে বলিরপাঠার মতো খুন হচ্ছে। কোথায় হারিয়ে গেল ছাত্রসমাজের পারস্পরিক ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ?কেন বই, খাতা,কলমের বিপরীতে ছাত্রের হাতে অস্ত্র দেখা যায়? জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান শিক্ষাঙ্গন গুলো কেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে? এটি জাতির জন্য কাম্য নয়। যে ছাত্রটি জীবন হারাচ্ছে, পঙ্গুত্ব বরণ করছে সে কারো না কারো সন্তান। সন্তান হারানোর ব্যথা একমাত্র পিতামাতাই বুঝতে পারে। জন্মগ্রহণের পর থেকে অবর্ণনীয় দুঃখ, কষ্ট ভোগ করে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য একজন পিতা তার সন্তানকে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন।প্রত্যাশা একটাই তারা প্রকৃত মানুষ হয়ে সমাজ, দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবে।জন্মদাতা হিসেবে একজন পিতার সার্থকতা এখানেই। আর এদের মধ্যে কেউ কেউ নোংরা রাজনীতির সংস্পর্শে এসে মানুষ হওয়ার পরিবর্তে দানবে রূপান্তরিত হয়। এদের হাতে প্রায় জীবন দিতে হয় নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার বেদনা কত করুণ তা কেবল তারাই বোঝেন যাদের সন্তান হারিয়ে যায়। এটা জাতির জন্য কাম্য হতে পারেনা। কয়েক দিন ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করে আসছে। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দেশের সিংহভাগ মানুষের সমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলনকে রাষ্ট্রের সম্মান জানানো উচিত ছিল। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে তাদের অভিযোগ শুনে কিছুটা হলেও কোটাপ্রথা সংস্কার করা যেতে পারতো।সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবক সুলভ আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীন সফর থেকে ফিরে ( ১৪ জুলাই, রোববার) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এক বক্তব্যে “আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতি” বলে আখ্যায়িত করায় শিক্ষার্থীরা অপমান বোধ করে। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রির এই বক্তব্যকে অপমানজনক বিদ্বেষপূর্ণ রাষ্ট্রীয় উপাধি হিসেবে বিবেচনায় এনেছে।
তারা নিজেদের রাজাকার বলে শ্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রির বক্তব্যের প্রতিবাদ করছে। “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার। যে বলেছে রাজাকার, সে হলো স্বৈরাচার। “এজাতীয় নানান শ্লোগান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখে শুনা যাচ্ছে।
তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করতে প্রতিবাদ স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালনে শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে সরকার আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে (আজ সোমবার, ১৫ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। এতে প্রচুর আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রচার মাধ্যমেের সুবাদে এই দৃশ্য দেশবাসী ও গোটাবিশ্ব দেখতে পেয়েছে। এটা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না। অবশ্য, এজাতীয় ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে এভাবেই নির্মম হামলা চালিয়ে ছিল ছাত্রলীগ।
এখন প্রশ্ন হলো, এ জাতীয় বক্তব্য কতটা প্রাসঙ্গিক? আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সত্যিই কী রাজাকারের নাতি? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এমন অপমানজনক স্বীকৃতি শুনে জাতি বিচলিত ও অপমানিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চিহ্নিত কিছু বিপথগামী রাজাকার ছিল। তাদের কৃতকর্মের জন্য কেউ কেউ শাস্তি পেয়েছে আবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময় নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজাকারকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, তা অবশ্য রাষ্ট্রের অজানা নয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ স্বতস্ফুর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছিল। কেউ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে,কেউ সংবাদ আদান-প্রদান করেছে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের দেখভাল ও সেবাশুশ্রূষা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে ,কেউ খাওয়ার সরবরাহ করেছে। আবার কেউ যুদ্ধের গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে।
শ্রদ্ধেয় কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা “স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো” কবিতায় মুক্তিযুদ্ধার প্রকৃত সংজ্ঞা ফুটে উঠেছে।
“কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্নবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানিরা দল বেঁধে ।” (অংশ বিশেষ)
সুতরাং মহান মুক্তিযুদ্ধে ঐসময়ের (গুটিকতক রাজাকার ছাড়া) সকল বাঙালির কমবেশি ভূমিকা ছিল। এই অর্থে পরোক্ষ -প্রত্যক্ষভাবে সবাই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার। তাছাড়া যে সন্তানটি মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণ করেছে অথবা মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরিণত বয়সী ছিল সে কেন রাজাকার তকমা (লোগো) বহন করবে? আমদের রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান সমস্যা হলো আদর্শিকভাবে কাউকে ঘায়েল করতে হলে রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। এই শব্দটির ব্যবহার এখন এতো ব্যাপ্তি লাভ করেছে যে, আমাদের কোমলপ্রাণ, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অভিভাবক, নিষ্পাপ তরুণ ছাত্রসমাজও রেহাই পাচ্ছে না। তা-ও আবার রাষ্ট্রপ্রধানের মুখ থেকে শুনতে হয়। জাতির স্বার্থে, রাষ্ট্রের কল্যাণে কথা বলার সময় অারও সংযত হওয়া উচিত।
তরুণদের বিশ্বাস করুন, ভালোবাসুন, আস্থায় আনুন। কারণ তরুণরাই প্রজন্মের সিপাহসালার।
এ দেশে এজাতীয় ঘটনা নতুন নয়,যতদূর মনে পড়ে, ২০১৮ সালেও নুরু এবং রাশেদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছিল।
কোটা প্রথার বিরুদ্ধে সেই সময়ও সারদেশে অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। অশান্ত হয়ে ওঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় গুলো। তখনো কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংসভাবে হামলা চালানো হয়েছিল। অথচ কোটা সংস্কার কোন দলীয় ইস্যু বা দাবী ছিলনা। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ব্যানার ও কণ্ঠে এই শ্লোগান গুলো সর্বত্র প্রকাশ পেয়েছে – “শেখ মুজিবের বাংলায়, বৈষম্যের স্থান নাই। শেখ হাসিনার বাংলায়, বৈষম্যের স্থান নাই।” তবুও সোনার ছেলেদের হাতুড়ি আক্রমণ,লাঠিপেটা,বুটের আঘাত থেকে তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো একটি দেশে সক্রিয় আইন শৃঙ্খলাবাহিনী থাকতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর এই হামলা চালানোর সাহস এবং দীর্ঘ সুযোগ কী করে তারা পেয়েছে? মিডিয়ার কল্যাণে এদের চেহারা ও রাজনৈতিক পরিচয় জাতির কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি যদি পালন করতে না দেওয়া হবে তবে তো পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করা যেতে পারতো। সন্ত্রাসী দিয়ে পিটিয়ে আহত করার পর গ্রেপ্তারের কি প্রয়োজন ছিল। জাতি বিষয়টিকে অন্য ভাবে নিয়েছে। এতে আগামীর তারুণ্য, ছাত্রসমাজ চরম অভিভাবকহীনতা বোধ করছে।প্রসঙ্গ ক্রমে কোটা আন্দোলনের নেতা মেধাবী ছাত্র আহত নুরুর কৃষক পিতার সেরা উক্তিটি এখানে উল্লেখ করতেই হয়,” আমার সন্তান আমার কাছে কিছু চাইতেই পারে। আমি পারলে দেব,না পারলে দেবনা। কিন্তু তাই বলে সন্ত্রাসী দিয়ে পিটিয়ে পুলিশে দিতে পারিনা।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দেশের অভিভাবক। অভিভাবক হিসেবে বাংলার কোটি সন্তান আপনার কাছে চাইতেই পারে। তাই বলে কী তারা হাতুড়ি পেটানোর শিকার হতে হবে? এই হাতুড়ি শুধু কোন একজন শিক্ষার্থীর পা ও মেরুদণ্ড ভাঙ্গেনি বরং গোটা জাতির মেরুদণ্ডে আঘাত হেনেছে।
অবিলম্বে এদের গ্রেপ্তার করে যথাযেগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী (অভিভাবক) হিসেবে জাতির কাছে আপনার ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
একজন খেটে খাওয়া কৃষক পিতা সাবলীল ভাষায় যে প্রতিবাদ করেছেন তা খুবই অর্থবহ, হৃদয়গ্রাহী এবং বজ্রকঠোর। যে পিতা নিজের চাওয়া -পাওয়া, ভোগ- বিলাস ত্যাগ করে সন্তানের লেখা- পড়ার খরচ জোগান, নিশ্চয় সন্তানের আয় -রোজগার ভোগ করার মানসিকতা থেকে নয়। তা অবশ্যই দেশ এবং সমাজ সেবার মানসিকতা থেকে করে থাকেন। নিজের সন্তান একদিন বড় হবে, সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, মানুষের সেবা করবে, একজন পিতা হিসেবে এটুকুই তার প্রাপ্তি এবং এখানেই জন্মদাতা নিজের সার্থকতা খুঁজে পান। এমন ত্যাগ -তিতিক্ষার অবস্থান থেকে নুরু,রাশেদের পিতার মতো হাজারো পিতার মর্মবেদনা অনুধাবন করার চেষ্টা করা উচিত।
উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে জ্ঞান অর্জন করতে আসা লাখো শিক্ষার্থী আমাদের জাতীয় সম্পদ। এদের রয়েছে অপরিমেয় তারুণ্যদীপ্ত গতি। আঠারো বছর বয়সের দুর্দান্ত গতিময় যৌবন এদের মনে। এ যৌবন শক্তিকে জাতি এবং রাষ্ট্রের অনুকূলে রাখা প্রয়োজন। এই যৌবন শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে যে কোন জাতি লক্ষ্য বাস্তবায়নে যেমন এগিয়ে যায় বিপরীত দিকে এই তারুণ্যের লাগাম ধরে রাখতে না পারলে জাতির ধ্বংস তরান্বিত হয়।
অতি সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঢালাওভাবে রাজাকারের বাচ্চা বলা হয়েছে। সবাই কেন রাজাকার হতে যাবে? এই বক্তব্যটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তুলতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। দায়িত্বশীল মহল থেকে এ ধরনের আচরণ কোন ভাবেই কাম্য হতে পারেনা। জঙ্গিবাদ গোটা বিশ্বে একটি স্পর্শকাতর ও উদ্বেগ, আতঙ্কের নাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ছাত্রদের অবাধে জঙ্গি বলে মন্তব্য করে, বক্তব্য দিয়ে আমরা তাদেরকে কোন পথে ঠেলে দিচ্ছি এ বিষয়টাও গভীর ভাবে ভেবে দেখা উচিত। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে এজাতীয় বক্তব্য অহরহ আসছে।
কোটা প্রথা জাতীয় জীবনে একটি সুস্পষ্ট বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। এই বৈষম্যের কারণে গোটা জাতির মাঝে হতাশা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। কোটা পদ্ধতির কারণে সরকারি নিয়োগ গুলোতে শতভাগ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা।নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভালো ফলাফল করার পরও কেবল কোটার কারণে মেধায় এগিয়ে থাকা প্রার্থীদের ভাগ্যে চাকুরী জুটেনা। ফলে বিভিন্ন দপ্তরে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা স্থান পায়। সীমাবদ্ধতার কারণে তারা নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন অনিয়ম,দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা প্রবল স্বেচ্ছাচারী হয়ে ব্যক্তি স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকে।এতে পারস্পরিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায় এবং তাদের মাধ্যমে জনসাধারণ ভোগান্তির শিকার হন ও যথাযথ ভাবে কাজ না করার কারণে কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটে। ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। অযোগ্য লোক নিয়োগ পাওয়ার কারণে রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। অপরাধ দমনের নামে নিজেই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। বিচারের নামে প্রহসন করে।শিক্ষার নামে অশিক্ষা শিখিয়ে থাকেন। অযোগ্য লোক জনপ্রতিনিধি হলে তার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। যার ফলে স্বদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা যেমন সম্ভব হয়ে ওঠেনা তেমনি কাঙ্ক্ষিত ভাবে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব হয়না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ঘুণেধরা অচলাবস্থা তা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে এর দ্বার উন্মুক্ত হয়। তার পর থেকে বাংলাদেশের ভাগ্যে সরকার আসে সরকার যায়। অভিনব কৌশলে পালাবদল ঘটে শাসন এবং শোষণের। দেশের উন্নয়নের চেয়ে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন ভিন্নমত দমন নিপীড়নে। দেশ ও জাতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় দলীয় স্বার্থকে। দলীয়করণের মহোৎসবের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশের যৌবন থেকে হারিয়ে গেল একে একে তিপ্পান্ন বছর । সুদীর্ঘ এই সময়ে কোন রাজনৈতিকদল বা সরকার এমন কোন স্ট্রং রাষ্ট্রীয় পলিসি বা নীতি- আদর্শ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে উপহার দিতে পারেনি,যেটি হতে পারতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির মজবুত ফাউন্ডেশন। যার উপর ভিত্তি করে অন্তত একশত বছর এগিয়ে যেতো বাংলাদেশ। আমাদের রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অভাবে আমরা পেয়েছি প্রতিহিংসার চর্চা। পেয়েছি দুর্নীতি,স্বজন প্রীতি, ঘুষ বাণিজ্য, সন্ত্রাস, হত্যা,ধর্ষণ,গুম,খুন ও প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাবিধ অপরাধ। এর মাঝে ভালো কিছু পেয়ে থাকলেও প্রতিহিংসার রাজনৈতিক কারণে তা জাতির জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠতে পারেনি।
যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এতগুলো প্রসঙ্গের অবতারণা, তা হলো আমাদের দেশে বিদ্যমান কোটাপ্রথা। একাত্তর সালে জন্ম নেওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ একটু একটু করে আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা ও সাক্ষরতায় বাংলাদেশ এখন আর পিছিয়ে নেই। নারী- পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা অর্জন করছে। বিগত বছরগুলোর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা পড়া- লেখায় অনেকাংশে এগিয়ে আছে। অাবার কোটা সংস্কারের দবীতে মেয়েরাও অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে। তাই বলছি, দেশে নারী-পুরুষ শিক্ষা যোগ্যতায় প্রায় সমান্তরালে এগিয়ে আছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী,স্পীকার নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, জাতীয় সংসদে এবং মন্ত্রণালয়েও রয়েছেন নারী। এছাড়াও শিক্ষকতা,আইন-আদালত, ব্যাংক, বীমা,রাজনীতি, সমাজ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নারীর উপস্থিতি এবং ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। নারীগণ এখন আর নিজেদের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী মানতে রাজী নয়। তাই নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের মাঝে সুনির্দিষ্ট কোটায় মেধাবৈষম্য বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। নারীর প্রতি এমন সহানুভূতির করণে সুবিধা বঞ্চিত পুরুষ নারী বিদ্বেষী হয়ে ওঠতে পারে।যা সমাজ জীবনে নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি শিক্ষারমান সমুন্নত রাখতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা (সমান) ন্যূনতম স্নাতক পাশ হওয়া উচিত। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা একজন ছাত্রের মৌলিক ফাউন্ডেশন। এখান থেকে শিক্ষার মজবুত ভিত্তি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সম্ভাবনা থাকেনা।
কোটানীতিতে বহূল আলোচিত বিষয় মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মুক্তিযোদ্ধাগণ বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এতে কোন আপত্তি বা অসম্মান পোষণ করার সুযোগ নেই। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রজন্মের কোন স্তর পর্যন্ত চলবে?এ ব্যাপারে সঠিক নির্দেশনা থাকা চাই। এটি যুগযুগ ধরে নাতি,পুতিসহ বংশানুক্রমে চলতে পারেনা। এটা জাতির মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বাংলার আপামর জনতা পরোক্ষ / প্রত্যক্ষ ভাবে (গুটি কতেক রাজাকার ছাড়া) মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এদের মাঝে অনেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ পাননি। আবার অনেকের ভূমিকা চোখে পড়েনি। এমনও অনেক রয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেন নি আবার রাণাঙ্গনেও যান নি, কিন্তু বাংলার স্বাধীনতাও মন থেকে কামনা করেছিলেন। পিতার এমন সীমাবদ্ধতার দায়ভার তার সন্তানকে কেন বয়ে বেড়াতে হবে? হাতে গোনা দুই লাক্ষাধীক মু্ক্তিযোদ্ধার নাতি- পুতিরা কোটা সুবিধা পেলে অন্যদের কী অপরাধ? এটা সুরাহা না হলে নতুন প্রজন্ম স্থায়ী বৈষম্যের কবলে নিপতিত হবে। এই নিয়মে পরিবর্তন না এলে নুতন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্মান ও শ্রদ্ধার স্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মোৎসর্গের বিষয়।কোন প্রতিদান প্রপ্তির বিষয় নয়। তাই শোষণ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে কোটা পদ্ধতিতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে। দেশের সর্বত্র সৎ এবং মেধাবীদের সর্বাগ্রে কাজে লাগাতে হবে। আর উল্লেখিত বিষয় গুলোতে গুরুত্ব সহকারে সঠিক প্রদক্ষেপ নিতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক , কবি ও প্রাবন্ধিক।