দৈনিক ফেনীর সময়

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের ভূমিকা: প্রেক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের ভূমিকা: প্রেক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

-নাসিরুদ্দীন তুসী

আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবদীপ্ত, হিরণময় অধ্যায়। এদেশের মানুষ আত্মত্যাগের মাধ্যমে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল ১৯৫২ সালে। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গৌরবময় পতাকা উত্তোলন, সংগ্রামী চেতনা, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদান, বিজয় অর্জন! অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ১৯৭১ পৃথিবীর সবুজ কপালে এঁকে দিয়েছে রক্তিম লাল টিপ। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যবাহী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ স্বমহিমায় ভাস্বর। সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, অনন্য অবদান ছাত্রসমাজের। ছাত্রসমাজের প্রেরণা ছিল তাদের শিক্ষকগণ। ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল কবি, শিল্পী, তথা বুদ্ধিজীবী নিধনের মধ্য দিয়ে, পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ শেষ করেছিল বুদ্ধিজীবী হননের মাধ্যমে'(রফিকুল ইসলাম, ২০১৬, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ)।
২৫ মার্চের কালরাত্রি! ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক, মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নেমে আসে বাঙালি নিধনের উদ্দেশ্যে। ‘শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল এবং হলসংলগ্ন শিক্ষকদের বাসগৃহে ভারী অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে।'(সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা, পৃ-১৮১, ২০১২, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়)।

ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ঢাকা। ‘১৯২১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় অনগ্রসর পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠীর সামনে উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বার উন্মোচিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা দানের সাথে সাথে পরিণত হয় সমগ্র পূর্ব বাংলার অর্থ সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্রে ‘(আয়শা বেগম,২০১১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: স্মৃতিনিদর্শন)। ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ দেশীয় স্বার্থে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছে।১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকগণ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীবৃন্দ জীবন উৎসর্গ করেন। স্বাধীন জাতিসত্তা বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালিকা শক্তি রূপে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের দাবির বুদ্ধিবৃত্তিক আঁতুড়ঘর ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাফল্যের পরে স্বাধীনতা পরবর্তী গণআন্দোলনগুলোতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।'(বাঙলানামা, ২০২১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা, পৃ-৬২)।

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক- কর্মকর্তাবৃন্দ: মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষকবৃন্দ আত্মদান করেছেন তাঁরা হলেন: বাংলা বিভাগের- আবু নায়েম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। ইংরেজি বিভাগের- জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এস এম এ রাশীদুল হাসান। ইতিহাস বিভাগের- গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মো. আবুল খায়ের, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য। ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের-অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। পরিসংখ্যান বিভাগের-এ এন এম মুনীরুজ্জামান। আই ই আর এর-এন এ এম ফয়েজুল মহী, মো: সাদাত আলী, সিরাজুল হক খান। ভূতত্ত্ব বিভাগের-এম এ মুকতাদির। দর্শন বিভাগের- গোবিন্দচন্দ্র দেব। মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের- ফজলুর রহমান খান। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের-আতাউর রহমান খান খাদিম। গণিত বিভাগের-সরাফত আলী। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলের শিক্ষক- মোহাম্মদ সাদেক। চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তার কর্মকর্তা-ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজা।

মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী ছাত্রবৃন্দ : সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের- ওয়াহিদুর রহমান, নজরুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন আজাদ, মো: সলিমুল্লাহ, মিয়া শাহজাহান কবীর, শেখ আবদুস সালাম, সিকান্দার হায়াত খান। জগন্নাথ হলের-অজিত রায় চৌধুরী, আনন্দ কুমার দত্ত, দীনেশ চন্দ্র শিকদার, নির্মল কুমার রায়, নিরঞ্জন চন্দ, প্রবীর পাল, পল্টন দাস, প্রদীপ নারায়ণ রায় চৌধুরী, ভবতোষ ভৌমিক, রবীন রায়, সত্যরঞ্জন রায়, সুভাষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সুব্রত সাহা। হাজী মুহম্মদ মহসীন হলের- খোন্দকার আবু তাহের, মঞ্জুর চৌধুরী। ফজলুল হক হলের- আবুল ফজল। ইংরেজি বিভাগের- কার্তিক শীল, কিশোর মোহন সরকার, বিধান চন্দ্র ঘোষ, শিশুতোষ দত্ত চৌধুরী, নাছিম মহসীন, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ জাহীন। বাংলা বিভাগের- মো: আজমল হক, মো: নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর মুনীর (১), মোস্তফা কামাল শাহরিয়ার। আইন বিভাগের- সৈয়দ শাহ জামাল চৌধুরী, আবু তাহের পাঠান, জাহাঙ্গীর মুনীর (২), সালেহ আহম্মদ, সৈয়দ রুহুল আমিন। গণিত বিভাগের- লুৎফুল আজিম, কেশবচন্দ্র হাওলাদার, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, রণদা প্রসাদ রায়, রাখাল চন্দ্র রায়। রসায়ন বিভাগের- গণপতি হালদার, জীবনকৃষ্ণ সরকার, রূপেন্দ্রনাথ সেন, সত্যরঞ্জন দাস। পদার্থবিজ্ঞানের- উপেন্দ্রনাথ রায়, ননীগোপাল ভৌমিক, নিরঞ্জন হালদার, মাশুকার রহমান। ভূতত্ত¡ বিভাগের-বরদাকান্ত তরফদার, মো.আবুল কাশেম। পরিসংখ্যান বিভাগের-বিমল চন্দ্র রায়, সুভাষ চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বপন চৌধুরী, মো: আবদুস সালাম, আশফাকুস সামাদ। বাণিজ্য বিভাগের-নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা, সুজিত দত্ত, মো: আবুল কালাম, খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া, জহিরুল ইসলাম। অর্থনীতি বিভাগের-মুরারী মোহন বিশ্বাস, মৃণাল কান্তি বোস, বদিউল আলম, মো. আব্দুর রহিম, মো: মনিরুজ্জামান, মোশারফ হোসেন, অরুণ চৌধুরী। অর্থনীতি বা দর্শন বিভাগের-রমণীমোহন ভট্টাচার্য, আব্দুল ওদুদ, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। মৃত্তিকা বিজ্ঞানের-শিবকুমার দাস, সুশীলচন্দ্র দাস, মো: মোস্তাক হোসেন, এটিএম জাফর আলম, শামসুজ্জামান, আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুল্লাহ হারুন, আতাউর রহমান, আব্দুস সালাম, মো. আশরাফ হোসেন, সন্তোষ কুমার রায়। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের-হরিনারায়ন দাস, মিরাজ উদ্দিন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের- সন্তোষ চন্দ্র রায়। ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের-জালাল উদ্দিন হায়দার। প্রাণ রসায়ন বিভাগের- মো. গোলাম মাহবুব। ফার্মেসী বিভাগের- মো. সিকান্দার আলী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের- মো.আশরাফ আলী খান, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুল বাকী। ইতিহাস বিভাগের-জিল্লুর মুর্শিদ, জাহাঙ্গীর হায়দার খান, রেজাউল করিম মানিক। ভূগোল বিভাগের- মো. আমিরুস সালাম। লোকপ্রশাসন বিভাগের-আনোয়ার হোসেন/ মনোয়ার হোসেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটের- মো.শাহনেওয়াজ, অমিত কুমার বসাক। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের-একেএম ওয়ালি উল্লাহ চৌধুরী।
এছাড়াও জীবন উৎসর্গ করেছেন বিভিন্ন হল ও বিভাগের প্রায় ৩১ জন কর্মচারী। (এই নামের তালিকা আমরা পেয়েছি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ডাকসু সংগ্রহশালা এবং প্রফেসর আয়শা বেগম রচিত “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:স্মৃতিনিদর্শন” গ্রন্থে)।

শহীদদের কবর : মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ছাত্র-শিক্ষক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে, শেষ হয়েছিল বুদ্ধিজীবী নিধনের মাধ্যমে। এই হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিছুদিন পর মিরপুর বধ্যভূমিতে তাদের গলিত লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মাত্র ৭ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ৬ জনকে কবরস্থ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে। অবশিষ্ট একজন-জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। তাঁর শবদেহ পরিবারের কাছে দেয়া হয়েছিল দাহ করার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবর এবং স্মৃতিনিদর্শন গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের শহীদ শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আত্মত্যাগের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্মৃতিনিদর্শন : শহীদদের স্মরণে ফুলার রোড আবাসিক এলাকার প্রবেশপথে একটি লাল ইটের তৈরি উঁচু স্মৃতিফলক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন এন্ড রিসার্চ তথা আই ই আর এর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বাগানে স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে ঢোকার প্রবেশ দরজার পাশে রয়েছে একটি স্মৃতিনিদর্শন। এতে রয়েছে ২৫মার্চ এর কালরাত্রিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের ৪জন শহীদ কর্মচারীর নাম।

শহীদ শিক্ষক,ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সহ অন্যান্যদের স্মারক নিদর্শন স্থাপিত হয়েছে ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে। স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ হয়েছে ১৯ জন শিক্ষক, একজন ডাক্তার (কর্মকর্তা), ১০১ জন ছাত্র, ৩১ জন কর্মচারীর নাম। ১৪টি দন্ডায়মান প্রাচীরের স্থাপিত হয়েছে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা)। ফলকের গায়ে লেখা আছে- “মরণ সাগরপারে তোমরা অমর তোমাদের স্মরি!”
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা গৌরবোজ্জল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

লেথক : কবি ও লেখক
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ।
বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!