দৈনিক ফেনীর সময়

মুমিনের আখেরাত ভাবনা

রশিদ আহমদ শাহীন

আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সবচে সম্মানিত, সবচে সুন্দর। চমৎকার ও আকর্ষণীয় অবয়ব এবং অধিক বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারীও মানুষ। সর্বোপরি সমগ্র সৃষ্টিজগৎ মানুষের অনুগত। সৃষ্টিজগতে অতি ক্ষুদ্র দেহাবয়বের এ মানুষ তার চেয়ে বহুগুণ বড় ও শক্তিশালী প্রাণী শিকার করতে এবং বশে আনতে সক্ষম। এ সম্মান আল্লাহ তাআলা শুধু মানুষকে দান করেছেন। সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে, “বাস্তবিকপক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।”

আল্লাহ তাআলা মানুষকে এতটা সম্মান, মর্যাদা, ক্ষমতা, ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য দান করেছেন পরীক্ষার জন্য এবং তাঁর আদেশ ও নিষেধ অনুসারে জীবন পরিচালনার জন্য। অন্যান্য জীবের মতো মানুষের পার্থিব জীবনই শেষ জীবন নয়; বরং এ জীবন অনন্ত জীবনের ভূমিকা। সকল মানুষ মৃত্যুর পর কৃতকর্মের হিসাব দেওয়ার জন্য একদিন আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াবে এবং প্রত্যেককেই তার কর্ম অনুসারে প্রতিদান দেওয়া হবে। এ দিন সম্পর্কে কুরআন কারীমে বলা হয়েছে:“তবে কি তোমরা মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না? অতি মহিমাময় আল্লাহ, যিনি প্রকৃত বাদশাহ। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।” সূরা মুমিনূন (১১৫-১১৬)

“আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি পরীক্ষার জন্য এবং আপনার মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য। আর আমি আপনার কাছে এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, পানি যাকে ধুয়ে ফেলতে পারবে না। আপনি নিদ্রায় ও জাগরণে তা তিলাওয়াত করবেন।”সহীহ মুসলিম (২৮৬৫)

বিভিন্ন ইমামগণ বিচার দিবসের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে মাযলুমের ওপর সংঘটিত সকল ঘটনা মূল্যায়নের পর একজন মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, এমন জুলুমের পর জালেমরা এভাবেই পার পেয়ে যাওয়া উচিত নয়।বরং যদি বিচার দিবস নির্ধারিত না হত, তাহলে প্রতিটি প্রাণী জুলুমের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ত। কারণ, জবাবদিহিতা নেই। এছাড়া যারা রবের প্রতি ঈমান এনেছে এবং সৎভাবে জীবন যাপন করছে তাদের কর্মের কী প্রতিদান?

“যারা অসৎ কার্যাবলিতে লিপ্ত হয়েছে, তারা কি ভেবেছে, আমি তাদেরকে সেই সকল লোকের সমগণ্য করব, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, ফলে তাদের জীবন ও মরণ একই রকম হয়ে যাবে? তারা যা সিদ্ধান্ত করে রেখেছে তা কতই না মন্দ! আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন এবং তা করেছেন এজন্য যে, প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে; যখন তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।” সূরা জাসিয়াহ (২১-২২)

মুমিনের আখেরাত ভাবনা ও দুনিয়া ভাবনা ভিন্ন নয়
একজন মুমিনের কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের বিভাজন নেই। ফলে মুমিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত। এখানে নিবেদনহীন সময় অথবা অন্য কারো জন্য নিবেদিত সময় নেই। ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ও মুহূর্তই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, তাঁর শরীয়ত ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে হবে।অন্যদিকে পার্থিব জীবন ও আখেরাতের ব্যাপারে অধিকাংশ জনসাধারণ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে আক্রান্ত। আমরা দুনিয়া ও আখেরাতকে আলাদাভাবে গ্রহণ করি। খালেস ইবাদতকে মনে করি আখেরাতের কাজ আর অন্যান্য সাধারণ কাজগুলোকে মনে করি দুনিয়ার কাজ। এভাবে দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে বিভাজনের পরিণাম ও পরিণতি কল্যাণকর নয়।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্য আমাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। শুধু মানসিকতা ও চিন্তাভাবনার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাহলেই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র সময়ও আল্লাহ তাআলার জন্য ও আখেরাতের জন্য হবে, ইনশাআল্লাহ।

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও কাজ হোক আখেরাতমুখী
মুমিন জীবনের ছোট থেকে ছোট যে কোনো মহৎ কাজ যেন হয় আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে প্রতিদান লাভের আশায়। একজন মুমিন জীবনের যে মুহূর্তগুলো নামায, রোযা ও হজ্বের মতো খালেস ইবাদতে, অর্থ উপার্জনের মতো প্রয়োজনীয় কাজে, পানাহার, ঘুম ইত্যাদি যেকোনো প্রয়োজন পূরণে এবং শারীরিক ব্যায়ামের মতো ক্ষেত্রে ব্যয় করে, তাতে যদি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়ত ও সুন্নাহ অনুসরণ করা হয়, তা আখেরাতের কাজ ও সওয়াবের মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়। পক্ষান্তরে খালেস ইবাদতেও যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য না হয়ে লৌকিকতা কিংবা দুনিয়ার মোহের মিশ্রণ ঘটে, তখন খালেস ইবাদতেও কোনো নেকী লাভ হয় না; বরং রিয়া বা লৌকিকতার গুনাহ হয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিয়তের ওপরই কাজের ফলাফল নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোনো নারীকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করবে, সেই হিজরত তার নিয়ত অনুসারেই হবে, যে নিয়তে সে হিজরত করেছে।” সুনানে আবু দাউদ (২২০১)

মুমিনের প্রতিটি মুহূর্তসওয়াব হাসিলের মাধ্যম
মুমিনের প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতমুখী ও সওয়াব হাসিলের মাধ্যম হওয়ার ব্যাপারে হাদিসে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে এসেছে। একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ধনী সাহাবীদের মতোই ইবাদত করি। কিন্তু ধনী সাহাবীরা দানও করে, যা আমাদের মতো অস্বচ্ছলদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর ফলে তারা আমাদের চেয়ে বেশি সওয়াব লাভ করছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীকে বললেন, “আল্লাহ তাআলা কি তোমাদেরকে সদকা করার মতো কিছুই দান করেননি? তিনি তো প্রতিবার তাকবীর তথা আল্লাহু আকবার বলায়, প্রতিবার আলহামদুলিল্লাহ বলায়, সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজে নিষেধে এবং সহবাসেও সদকাসম সওয়াব দান করেন।” সহীহ মুসলিম (১০০৬)

আল্লাহ গোনাহ ক্ষমা করে দেন
আবু সাইদ খুদরী ও আবু হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, “মানুষ যে ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, দুর্ভাবনা এমনকি গায়ে যে কাঁটা বিঁধে এর বিনিময়েও আল্লাহ তাঁর কিছু গোনাহ ক্ষমা করে দেন।”সহীহ বুখারী (৫৬৪১)

বিপদ, দুঃখ ও দুর্দশার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা ও যাচাই করেন যে, তাঁর কোনবান্দা সবচেয়ে ভালোভাবে তাঁর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ফলে বিপদ ও দুঃখ-দুর্দশায় আক্রান্ত হওয়ার পর অধৈর্য ও হতাশাগ্রস্ত হওয়া, আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যাওয়া এবং ‘এটা হলে এটা হত’ এমন অনর্থক প্রলাপ ও চিন্তা-ভাবনা উচিত নয়। সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে, “আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনো) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনো) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনো) জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। যারা তাদের কোনো মুসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, ‘আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হেদায়েতের ওপর।” সূরা বাকারা (১৫৫-১৫৭)

প্রতিটি ভালো কাজ সদাকাহ
মুমিনের প্রতিটি কাজকে এভাবে আল্লাহমুখী ও উভয় জাহানে অর্থবহ করার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি কাজ স্বভাবসিদ্ধ, শরীয়ত মোতাবেক এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহসম্মত হওয়া। প্রতিটি কাজের পূর্বে নিয়ত পরিশুদ্ধ করা এবং নির্ধারিত দুআ পাঠ করা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন হয় আল্লাহ তাআলার যিকির, ভয় ও তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। সকাল ও সন্ধ্যায় জীবনের এমন সকল মুহূর্ত ও কাজই নিয়ত ও উপলব্ধির বিশুদ্ধতার মাধ্যমে নেক আমল হতে পারে।

শেষকথা, মুমিনের জীবনে দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে বিভাজন নেই; বরং মুমিনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ তাআলার জন্য, আখেরাতের জন্য।

লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!