ঈদ ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর দু’বার মুসলিম বিশ্বে ঈদ উৎসব উদযাপন করা হয়। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উভয় ঈদেরই স্বতন্ত্র মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবুও ঈদুল ফিতর যেন বহু কাঙ্খিদ। এর বহু কারণ রয়েছে। দীর্ঘ ত্রিশ দিন সিয়াম সাধনার পর এ দিনটি প্রতিটি মুসলিম পরিবারে আনন্দের অনাবিল বন্যা বয়ে আনে। ঘরে ঘরে দেখা যায় কোলাহল মুখর পরিবেশে নয়নাভিরাম পোশাকের সমারোহ। শিশুমনে জেগে ওঠে আনন্দের হিল্লোল। ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব বাঁধনে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসায় মুখরিত হয় প্রতিটি হৃদয়। এ দিনটির উৎসব,আনন্দ শুধু মুসলিম পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকেনা। প্রীতি ও সামাজিক বাঁধনে মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাসরত মানুষের নৈতিক গুণাবলী বিকাশের জন্য, পৃথিবীতে সাম্য-শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে ঈদ উৎসব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ধর্মের মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কিছু বিশেষ ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্যও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দু’টি ধর্মীয় উৎসব নির্ধারিত রয়েছে। যা তাদের শিক্ষাদেয় সকল ভেদাভেদ, সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কৌলীন্য প্রথা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভুলে ভ্রাতৃত্বেও বাঁধনে আবদ্ধ হতে।
ঈদের দিনে মুসলমানেরা সকলে মিলে মিশে আনন্দ করে এবং ধনী ও দরিদ্র সকলে সাম্যের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে আপন করে নেয়। এই দিনে সকলে তাদের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা -বেদনা, জরা-জীর্ণতা সহ সকল প্রকার বিভেদ ভুলে যায়। বিশ্বমুসলিম ঈদ উৎসবে একে অন্যের হাতে হাত মিলায়,বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করে প্রতি বছর নতুন করে সাম্য ও মৈত্রির বাঁধনে আবদ্ধ হয়।
ঈদ অর্থ আনন্দ, ঈদ অর্থ খুশি। ঈদ গোটা মুসলিম উম্মাহর প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ঈদের দিনকে ফেস্টিবল মোড এ উদযাপন করে। এই দিন শুধু নিজে আনন্দ করবে, নিজে পেট পুরে খাবে, নিজে নতুন পোশাক পরিধান করবে এমন ভোগবাদী মানসিকতা পরিহার করে ত্যাগের সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারা ঈদ উৎসবের মূল শিক্ষা। সমাজের ছিন্নমূল, গরিব-দুস্থ, অসহায়, অনাহারী, ভুখা-নাঙ্গা, টোকাই- পথশিশু, রোগাক্রান্ত অসুস্থ মানুষদের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে মমতার বাঁধনে আপন করে নিতে পারাই সাম্যের প্রেরণা। আর এটাই হলো ঈদ উৎসবের মূল ভিত্তি।
এ শিক্ষা সমগ্র মনবতার জন্য। ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম। ইসলামি সাম্যবাদের সুফল তামাম জাহানের সকল বনি আদম ভোগ করবে। একেই বলে ইসলামি সাম্যবাদ। এক আল্লাহর সৃষ্টি জগতের নেয়ামত গোটা বিশ্বের সকল প্রাণী যেমন করে ভোগ করছে তেমনি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যবাদের সুফল ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব জাতি ভোগ করবে। এটি কোন সাম্প্রদায়িক বিষয় নয়। ইসলাম অর্থ শান্তি, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সমাজে বসবাসরত সবশ্রেণী গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায় এই শান্তির সুবাতাস গ্রহণ করবেন।
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত। রমজান মাস পবিত্র কুরআান নাজিলের মাস। এই মাসে কুরআন অবর্তীর্ণ হওয়ায় আরবি অন্যান্য মাসের চেয়ে রমজান মাস বিশেষ গুরুত্ববহন করে। এটি সিয়াম সাধনার মাস, তাকওয়া অর্জনের মাস। রোজা অবস্থায় সকল পানাহার, কামাচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, মিথ্যাচার, নগ্নতা, অসাধুতা, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, ঝগড়া-বিবাদসহ সকল প্রকার অপরাধের ব্যাপারে বিশেষ কঠোরতা আরোপ করা হয়ছে। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। মুসলিম সম্প্রদায় যদি এই মাসে আল্লাহর নির্দেশিত বিধি-নিষেধ মেনে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের যেমন মানবতার জন্য পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়তে পারবে আবার অন্য দিকে সমাজ হবে অপরাধ মুক্ত। তখনই কেবল একজন মানুষ অপরাপর মানুষের সুখ দুঃখের নিরন্তন সহযোদ্ধা হয়ে উঠবে। অপরের দুঃখে কাঁদবে, অপরের সুখে হাসবে। আর তখনই সাম্যবাদী চেতনাবোধ জাগ্রত হবে। বিকশিত হতে থাকবে ভ্রাতৃত্ববোধ।
রমজানের এক মাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সাধনায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দে এবং সংযম, ত্যাগ, আত্মগঠন ও জাতি গঠন এবং সাম্যবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্ব মুসলিম পালন করেন “ঈদুল ফিতর”। এ দিনে প্রতিটি মসলিম ঘরে প্রতিধ্বনিত হয় আনন্দের সুমধুর সুর। ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ঘরে কম বেশি এই আনন্দ বিচ্ছুরণ হয়। ধনীদের সম্পদে রয়েছে দরিদ্র মানুষের অধিকার। যাকাত ও ফেতরা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের গরিব- অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটে, তাদের অভাব অনটন দূর হয়। নতুন পোশাকের ছোঁয়া তাদের ছোট ছোট শিশুদের মনেও আনন্দ জাগায়। এই দিন ফিরনি-পায়েসের ঘ্রাণ অসহায় মানুষের জীর্ণ কুঠির থেকেও বেরিয়ে আসবে। এতে ধনী ও দরিদ্র মানুষের ব্যবধান কমে যাবে। কেউ খাবে কেউ খাবেনা, কেউ পরবে কেউ পরবেনা এমন বৈষম্য থাকবেনা। আর এটাই হলো ইসলামী সাম্যবাদের শিক্ষা।
ঈদের দিন সকালে গোসল করে শিশু-কিশোর, ছেলে-বুড়ো, নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে।সবাই খুশি মনে ঈদগাহে যায়। ঈদের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে কে ধনী, কে দরিদ্র, সেদিকে না তাকিয়ে ছোট-বড় নির্বিশেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে। এতে প্রমাণিত হয় মুসলমানেরা পরস্পর ভাই ভাই। একে অন্যের আপন। রোজা ভ্রাতৃত্ববোধ ও নিয়মানুবর্তীতার শিক্ষা দেয়। রোজাদার ব্যক্তি উপবাসের দ্বারা দরিদ্রের অনাহারের তথা ক্ষুধার কষ্ট উপলব্ধি করার মধ্যদিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। রোজা মুসলিম সমাজে পবিত্র ও পূর্ণ্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে সমাজের মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত করে। এই মাসে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ্য পরিবেশ বিরাজ করে। পুরো পৃথিবী মহান আল্লাহতায়লার অফুরান রহমতের ফল্গুধারায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। রমযান মাসে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানকে করা হয় বন্দি।
রোজাদার ব্যক্তি এই সুযোগ পেয়ে তাকওয়া অর্জন করতে আর কোন বাঁধা পায়না। আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। রোজা মুসলিমদের ধৈর্যশীল ও সংযমী হতে শেখায়। ধৈর্য মানব জীবনের অন্যতম গুণ। ধৈর্যের মাধ্যমে মানব জীবনের যেকোন সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। মহান রাব্বুল আলামিন ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে তাঁর নিকট সাহায্য কামনা করতে বলেছেন।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার রিপুগুলো দমন করতে পারে। কামাচার-ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজের আত্মাকে মুক্ত রাখতে পারে। রোজাদার মুসলিম রোজা পালনের করণে আাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি সাধন করে। সিয়াম সাধনকারী মুসলিম সিয়ামের মাধ্যমে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিভিন্ন মানবীয় গুণাবলী অর্জনসহ মানবীয় জীবনের সার্বিক সফলতা লাভ করে।
সিয়াম সাধনা মুসলিমদের হিংসা, বিদ্বেষ ও লোভ, লালসা ভুলে যেতে শেখায়। এবং তাদের নৈতিক ভিত্তি মজবুত করে। নৈতিকতার গুণাবলী থেকে আদর্শ সমাজ, আদর্শ দেশ, আদর্শ জাতি গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে এবং দেশপ্রেম জাগ্রত ও সুদৃঢ় করে। সাম্য প্রতিষ্ঠায় সমাজের উঁচু-নীচু ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ ভুলে যেতে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। সামাজিক সাম্যের জন্য রোজা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সমাজে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ, অন্যের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, হৃদ্যতাপূর্ণ্য বন্ধুবৎসল সম্পর্ক বজায় রাখার নাম ভ্রাতৃত্ব। প্রতিটি মুসলিম ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য। ভ্রাতৃত্বের পথে প্রতিবন্ধকতা ও স্বার্থপরতা ইসলামে নিষিদ্ধ। একই আদর্শে গড়ে ওঠা বিশ্বভ্রাতৃত্ব সিসাঢালা প্রাচিরের মতো মজবুত ও দৃঢ়। শান্তিময় পৃথিবী গড়তে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ অপরিহার্য। পৃথিবীতে প্রথম ইসলাম ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিশ্বভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের সমাজ বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে ইসলাম। ভ্রাতৃত্বের এ মূল্যবোধ অন্য কোথাও পাওয়া যায়না। বিশ্বভ্রাতৃত্বের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণের বেড়াজাল ছিন্ন করে ধনী- গরিবের বৈষম্য দূরীভূত করে সকলে এক ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিতে বসবাস করা।
পৃথিবীর মানবগোষ্ঠী আজ দ্বিধা বিভক্ত। বহুবিধ মতবাদের পেছনে ঘোরে ফিরে মানুষ চরম হতাশায় কবলিত। যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারণাস্ত্রের মহড়া, হুমকি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সব কিছু যেন মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে। দিকবিদিক ছুটছে মানুষ মুক্তি ও শান্তির আশায়। ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদসহ কোন অপরাধের স্থান নেই। তাই বলা যায়, বিবাদমান পৃথিবীর মানুষগুলোকে যদি আবার ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় দেওয়া যেতো তাহলে গোটা পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করতো।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।