এই লেখানীর প্রথম অংশে নামাজের ভিতর বাহির কতিপয় দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে ইচ্ছা ফতোয়া শিরোনামে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, অনেক সময় অনেক মুহাক্কীক আলেমে বিভিন্ন আলোচনায় যৌক্তিক কিংবা দালিলিক দ্বীনের হুকুম-আহকাম বিষয়ে হুট করে একক মত দিয়ে বসেন। এর ফলে দেশে-বিদেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। যদ্বদ্বারা পক্ষে বিপক্ষে দলাদলি, হানাহানি এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়। সমগ্র লেখাটি একজন মুসল্লী কিংবা সচেতন মুসলিম হিসেবে যা কিছু দীর্ঘ সময় থেকে ভ্রম অথবা ভ্রান্তি বলে মনে হয়েছে সেই আলোকে ব্যক্তিগত মতামত বিশেষ।
মোনাজাত ও বেখবরী ইমাম : প্রত্যেক ফরজ সালাতের জামায়াতে নামাজ শেষে ঘটা করে সম্মিলিত মোনাজাতের বিষয়ে নবী মুহাম্মদ সাঃ থেকে সুস্পষ্ট কোন দলিল পাওয়া না গেলেও শৈশব থেকে এটিকে চলমান প্রতিষ্ঠিত একটি ধারা হিসেবেই দেখে আসছি। বিভিন্ন হক্কানি ওলামায় কেরামের বয়ানেও সম্মিলিত মোনাজাতের পক্ষে শক্তিশালী মত পাওয়া যায়না। বিশেষ কিছু সময়েও ক্ষেত্রে সম্মিলিত মোনাজাতের গুরুত্ব ও ফজিলত বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
মোনাজাতের কিছু প্রসিদ্ধ সময় : আজান ও ইকামতের মাঝখানে দোয়া কবুল হয়। সেজদায় দোয়া কবুল হয়। শেষ রাতে (তাহাজ্জুদ’এর নামাজ বা বিশেষ নফল ইবাদত) দোয়া কবুল হয়, ইফতারের পূর্বক্ষণে রোজাদারের দোয়া কবুল হয়। শবেক্বদর ও দুই ঈদের নামাজ শেষের মোনাজাতে দোয়া কবুল হয় মর্মে বিভিন্ন বর্ণনায় ও কিতাবাদীতে এসেছে।
এই লেখাটি সম্মিলিত মোনাজাতের বিপক্ষে বা মোনাজাত নিরুৎসাহিত করণের লক্ষ্যে কোন বক্তব্য উপস্থাপন উদ্দেশ্য নয়। নবী মুহাম্মদ সা: এর বিভিন্ন হাদীসে প্রমানিত সত্য হলো একাকী মোনাজাত। ড: আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মুফতি ইব্রাহিম, মুফতি আহমদ উল্যাসহ অসংখ্য ওলামায় কেরাম একাকী মোনাজাতের পক্ষে নবী মুহাম্মদ সাঃ সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
সম্মিলিত মোনাজাতের দুর্বল দিক ও যা লক্ষণীয় : ইমামের সুরেলা মোনাজাত যদি নামাজরত কোন মুসল্লীর মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বা নামাজ ভঙ্গের উপক্রম হয় তবে ঐ নামাযের দায় কার? বিষয়টা আরেকটু পরিস্কার করা যাক- জামায়াতে নামাজ চলাকালীন অবস্থায় দ্বিতীয় রাকাত, তৃতীয় রাকাত বা শেষ বৈঠকেও কতিপয় মুসল্লী নামাজে জমায়েত বদ্ধ হয়ে থাকেন। ইমাম সাহেব সালাম প্রকাশের মাধ্যমে নামাজ শেষ করার পর মাঝামাঝি বা শেষপর্যায়ে যে বা যারা জমায়েত বদ্ধ হয়েছিলেন তারা অসম্পূর্ণ নামাজ শেষ করতে দাঁড়িয়ে সূরা কেরাত পাঠে মনোযোগী হন। অপরদিকে ইমাম সাহেব রাশভারী গলায় মাইক্রো ফোনে আরবি বাংলায় দোয়া পাঠ করতে থাকেন। এমনিতেই নামাজে একাগ্রতা বজায় রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে সেখানে মোনাজাতের আওয়াজের সাথে নামাজরত মুসল্লীর নিরব তেলাওয়াতে বিগ্ন ঘটার সম্ভাবনা অনেকখানি। এছাড়াও জামায়াত শেষে একাকী যারা নামাজ পড়তে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও মনোযোগ ভংগের শংকা থাকে।
প্রসঙ্গ-২ : ফজরের নামাজ শেষ হবার পর ইমাম সাহেব ও জামায়াতে নামাজ আদায়কারী মুসল্লী যারা তাসবিহ তাহলিল করতে থাকেন কিছু সময় বাদ ইমাম সাহেব সূরা হাসরের শেষ ৩ আয়াত পড়ার জন্য ‘আউজুবিল্লাহ হিছ ছামিউল আলিম মিনাশ শাইত্বোয়ানির রাজিম’ এই বাক্য গুলো পড়তে শুরু করেন। অমনি সমবেত মুসল্লীগণও সুরে বেসুরে বেশ আওয়াজ করে ইমামের সাথে কন্ঠ মেলাতে শুরু করে। এই সম্মিলিত আওয়াজ শোর চিৎকারের আকার ধারণ করলেও ইমাম সাহেবের সেদিকে কোনো নজর থাকেনা। এ ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব আরও উঁচু গলায় দরুদ শরীফ পাঠ করে মোনাজাত শুরু করেন। ইতিব্যস্বরে মসজিদের ভিতরে অপর কোনো লোকের নামাজে ব্যাঘাত ঘটছেকিনা তা আর ইমাম মুয়াজ্জিন, মোক্তাদী কারোরই খেয়াল করার প্রয়োজন পড়েনা। এ ধরনের আওয়াজে নামাজরত ব্যক্তির সূরা কেরাত পাঠে বিগ্ন ঘটলে তার দায় কার? তাই সম্মিলিত দোয়া দরুদ পাঠ ও মোনাজাতের ক্ষেত্রে ইমামদের এসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী বলে মনে হয়।
ইচ্ছা ফতোয়া : হুটহাট নব্য ফতোয়া। ফেতনা সৃষ্টির দায় নেবে কে ? কয়েক মাস আগে সাঈদ কামাল উদ্দিন জাফরী এক বক্তৃতায় বলেছেন জুমা’র সালাতের আগে পরে কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা (৪ রাকাত বিশিষ্ট) কোনো নামাজ নাই। সহি কোনো হাদীস দ্বারা এর যতার্থতা প্রমান পাওয়া যায়না। তাঁর এই কথায় সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা সমালোচনাসহ তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও মন্দ বিশ্লেষণ চাউর হতে থাকে। ওলামায় কেরামদের মাঝেও ক্ষোভের সঞ্চার হতে দেখা যায়। এর মধ্যে একই বিষয়ে একই রকম মত প্রকাশ করেন মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্যাহ। এ পর্যায়েও সমালোচনা হতে দেখা যায়।
ধরে নিলাম তাঁরা উভয়ে সত্য মত প্রকাশ করেছেন। এই দুইজন আলেম বাংলাদেশ তথা বহিঃবিশ্বে অপরিচিত নন। ব্যাপক ভাবে পরিচিত। তাদের বয়স ৬০ থেকে তদূর্ধ্ব হতে পারে। তারা মসজিদ মাদরাসায় খেদমত করার পাশাপাশি টেলিভিশন, স্যোশাল মিডিয়া এবং মাঠে ময়দানে দীর্ঘ বছর েেথকে দ্বীন প্রচারে কথা বলে আসছেন। তারা ছাত্রত্ব কিংবা অধ্যায়ন কাল শেষ করেছেন ৩৫-৪০ বছর হবে হয়তো। তারা ছাত্র থাকাকালীন কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা নিশ্চয়ই পড়েছেন। কোনো মাদরাসার পক্ষ থেকে কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা নাই বলে অদ্যাবধি কোনো ফতোয়া আসে নাই। কাজেই কওমি আলিয়া সব মাদরাসা শিক্ষায় এটি চলমান আছে। তারা যে সকল মসজিদে (বয়সের দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য মসজিদে) ইমামতি করেছেন এবং করছেন। সেসব মসজিদে কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা নাই বলে অতীতে কথা বলেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায় নাই। যদি কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা বলে ৪ রাকাত বিশিষ্ট কোনো নামাজের বিধান না থাকে, তবে এই মর্মে বহু বছর আগে থেকে শোরগোল পাওয়া যেত। সাম্প্রতিক সময়ের আগ পর্যন্ত কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা’র নামাজ তাঁরা নিজেরা অনুসরণ করেছেন কি করেন নাই সে প্রসঙ্গে তাঁরা কিছুই বলেন নাই।
কিন্তু হঠাৎ করে দ্বীনের একটি প্রচলিত আমল (কাবলাল জুমা – বা’দাল জুমা) নাই বলে কেন ফতোয়া দিতে গেলেন?
বাংলাদেশে লক্ষাধিক কওমি মাদরাসা সহ আলিয়া এবং অন্যান্ন মিলিয়ে দুই লক্ষাধিক মাদরাসা রয়েছে। এসকল মাদরাসার মধ্যে ধরে নিতে পারি নূন্যতম ২’শতাধিক প্রসিদ্ধ মাদরাসা আছে। কয়েক হাজার প্রসিদ্ধ আলেম আছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীন প্রচারের সময় থেকে অদ্য পর্যন্ত কয়েক’শ বছরে কেউ এই ভুল ধরতে পারলেননা। বিশ্বের নামী-দামী কোনো মাদরাসা, বিশ্ববিখ্যাত কোনো আলেম এই ভুল ধরতে পারলেননা। তারা হঠাৎ করে ভুল ধরলেন এবং স্ব-উদ্যোগে তা প্রকাশও করলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-
বহু বছরের প্রচলিত একটি আমল সম্পর্কে কেউ একজন হঠাৎ করে ভুল ধরলেন, ফতোয়া ছুঁড়ে দিলেন, এ ধরণের একক ফতোয়া দেয়া কি যুক্তিযুক্ত? ইসলামের শিক্ষা ও অনুশাসনের বিষয়ে তাঁদের পান্ডিত্যের গভীরতার কাছে আমার জ্ঞান নিতান্তই তুচ্ছ। তাঁদের পরামর্শ দেয়ার মতো কোনো যোগ্যতা আমার নাই। কিন্তু তাঁরা যে ফতোয়া দিয়েছেন এবং সেই প্রেক্ষিতে যে ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হযেছিল সেদিকে দৃষ্টিপাত করে আমি শুধুমাত্র আমার মতামত প্রকাশ করছি।
আমার মতে তাঁরা নিম্নোক্ত পন্থা অনুসরণ করলে সর্বাধিক উত্তম হতো বলে মনে হয়।
১. বহু বছরের প্রচলিত যেকোন আমলের ভুল সম্পর্কে যদি প্রকৃত কোন দলিল পাওয়া যায়, তবে ঐ প্রেক্ষিতে ইসলামি আন্তর্জাতিক শরিয়া বোর্ডের বক্তব্য উপস্থাপন ও মতামত চাওয়া।
২. উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় মতামত চাইতে পারতেন।
৩. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে উপযুক্ত দলিল দিয়ে মতামত চাওয়া যেত। (বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ইসলামিক তথ্য পুস্তক সম্পর্কে অদ্যাবদি কোনো বিরূপ মন্তব্য বা ওমুক দলিল, ওমুকের লেখা ইত্যাদি ভূল তা প্রত্যাহার করা হোক, এমন কোনো ঘটনা আমার জানামতে ঘটেনি) তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিকট মতামত চাইলে তারা বোর্ড গঠন করে হাঁ না মতামত নিশ্চয় দিতেন।
৪. কওমি মাদরাসা সমূহের সম্মিলিত বোর্ড বা ফতোয়া বোর্ডে মতামতের জন্য দলিল পেশ করা হলে তারাও মতামত দিতেন।
৫. বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করতে পারতেন।
-এরপর তাঁরা এ মত প্রচার করা যুক্তিযুক্ত হতো বলে মনে করি। এর কোনোটি না করে হাজার বছরের একটি আমল সম্পর্কে একক কামেলিয়াত জাহির করলেন। এ ধরনের জ্ঞানের বড়ত্ব দীনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ? তাঁদের এই ফতোয়ার ফলে নামাজ বিমুখ তথা অলস, ফাঁকিবাজ মুসল্লীদের উৎসাহ যোগাবে। জুমা’র দুই রাকাত ফরজ সালাতের সালাম ফিরানো বা মোনাজাতের পর অধিকাংশ মুসল্লী যেমন চলে যায়, তারা আরো বেশী উৎসাহী হবে। যারা আমলের সাথে জুড়ে থেকেছে তাদের মধ্যেও মতদৈততা তৈরী হবে এবং আমল কম করার প্রবনতা তৈরি হবে।
বুজুর্গদের কাছ থেকে শোনা, জ্ঞান এবং বড়ত্বের অহংকার শয়তানের কাজ। যার কোন মুরব্বি নাই, পরামর্শক নাই, তার মুরব্বি বা পরামর্শক হয় শয়াতান।
পরামর্শ করে কাজ করা অথবা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহন করা নবী মুহাম্মদ সাঃ এর সুন্নত। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সুন্নত অনুসরণ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়না।
এধরণের হুটহাট ইচ্ছা ফতোয়া, মন চাহে কথা বলা দ্বীনের জন্য হুমকি ও ক্ষতিকর। আল্লাহ আমাদের নিজ দয়ায় ও অনুগ্রহে নবী করিম সাঃ এর আদর্শ অনুযায়ী আমল কারার তথা আমলের সাথে জুড়ে থাকার তাওফিক দান করুন।
লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।