একি খেলা চলছে হরদম’ আশির দশকে সাড়া জাগানো দর্শক নন্দিত একটি বাংলা ছায়াছবির গান। গানের কথাগুলো নানান ভাবে ঘুরেফিরে এখনো প্রাসঙ্গিক। হরেক রকম খেলার দৌড়ে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। খেলার মল্লযুদ্ধ এমনযে সাধারণ মানুষ খেলোয়াড়তো নয়ই দর্শক সারিতেও নেই, নির্বাক শ্রোতা মাত্র। সর্বগ্রাসী দানব চক্রের বেপরোয়া লোভের কাছে দেশে-বিদেশে মর্যাদা হারাতে বসেছে সরকার ও রাষ্ট্র। দপ্তরে দপ্তরে ঘুষ দুর্ণীতির সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের লাগামহীন ঘুষ, দুর্ণীতি, স্বেচ্চাচারীতা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারী দপ্তর থেকে সেবা নিতে উপরি দিয়েও অনুনয় বিনয়ের শেষ থাকেনা। উচ্চ শিক্ষিত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি থেকে পিয়ন, ঝাড়ুদার কে নেই আর্থিক লোভ ও চারিত্রিক দস্যুতার অসম প্রতিযোগিতার কাতারে।
হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর খেলাপি। তার উপর আছে হাজার হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি। সবই কতিপয় রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীদের জন্য যায়েজ। বিদেশে নিরাপদে অর্থ পাচার, নামে বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া। এ সবই করা হচ্ছে বিশেষ সিন্ডিকেট কৌশলে।
ব্যাংক পরিচালকেরা আগে নিজের ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নিতেন। আইনি বাধার কারণে সেই সুযোগ কমে গেলে তারাও আইনের সাথে নিজেদের কৌশল বদল করে আইনকে নিজেদের ইচ্ছের জায়গায় স্থাপন করতে সামর্থ্য হয়। এতে এক ব্যাংকের পরিচালক অপর ব্যাংকের পরিচালককে ঋণ পাইয়ে দিতে আঁতাতের মাধ্যমে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। একে কৌশলগত সিন্ডিকেট সখ্যতা বলাচলে। এখন সেই সিন্ডিকেট সখ্যতার পরিচালকরা ‘অশুভ আঁতাত’–এর মাধ্যমে একে অপরের ঋণের পুরো সুদ মওকুফ করে নিচ্ছেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানাযায়, গত ৩ বছরে এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। আবার ঐ একই গ্রুপের সব ঋণের সুদ মওকুফ করে দিয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। রাজধানী ঢাকার একটি গ্রুপের ঋণের সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ইসলামী ধারার ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো পড়ছে ঝুঁকিতে। আর সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়েছে জনগণের আমানত।
চর্তুরদিকে নানানভাবে ফুটে উঠেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতাবানদের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। যারা অর্থ সম্পদ লুট করছে এরা কেউই বাংলাদেশেকে তাদের নিরাপদ বসবাসস্থল মনে করেনা। ব্রিটিশ বেনিয়াদের লুটতরাজ, ভোগ, ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে এদের চরিত্র ও কার্যকলাপের বিন্দু মাত্রও অমিল খুঁজে পাওয়া যায়না।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি বেনজির আহমেদের লুটের সাম্রাজ্যের পাশাপাশি তিনি সাতটি পাসপোর্টের অধিকারী ছিলেন। এই সাতটি পাসপোর্টের কোনটিই সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে করেননি। সবগুলো পাসপোর্ট তিনি বেসরকারি চাকরিজীবী হিসেবে নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও আছে তুরস্ক, পর্তুগাল এবং পাপুয়া নিউগিনির পাসপোর্ট। তার পরিবারের সদস্যদেরও এই তিনটি দেশের পাসপোর্ট রয়েছে বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্বে থাকা বেনজির এবং তার পরিবারের বাংলাদেশের প্রতি নূন্যত দেশপ্রেম ছিলো কিনা? বর্তমানে পুলিশের শীর্ষপদের এই কুলটা বরপুত্র স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বিদেশে আত্মগোপনে আছেন বলেই সবাই ধারণা করছে।
অন্যদিকে অবসরে থাকা ডিআইজি আসাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে। পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিশনাল আইজিপি) ড. শামসুদ্দোহা খন্দকারের বীরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের। শুধু দোহা একা নন, তার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানারও রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। পুলিশের আরেক কর্মকর্তা যেকিনা তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে চাকরিতে যোগদান করেন এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নামের ফলবৃক্ষ কাজে লাগিয়ে সরকারি জমিও হাতিয়ে নিয়েছেন। এই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের নাম রফিকুল ইসলাম মিয়া। গোপালগঞ্জের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আওয়াজ তুলেছেন তাঁর বাবা কখনো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। রফিকুল ইসলাম মিয়ারও নামে বেনামে হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে।
মতিউর রহমানের ছাগলকান্ডের গল্পপাঠ শেষ হতে না হতেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আরেক কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নাম উঠে এসেছেন তদন্তের আওতায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ কর্মকর্তা প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
দুর্ণীতির ছায়া থেকে দুরে নেই ব্যাংক কর্মকর্তারাও। ভুয়া ঋণের মাধ্যমে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ঘটনার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যায়ের কতিপয় ভিসিদের অনিয়ম, দুর্ণীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্রয় দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। কলেজের পিয়নের কোটি টাকার বাড়ী। উপজেলা সহকারী ভূমি রেজিস্ট্রারের বরিশাল ঢাকায় কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় যে টুকু দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা যৎসামান্যই বলা চলে।
দুর্ণীতির অবৈধ সুখস্পর্শে পিছিয়ে নেই রাজনীতিবিদরাও। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া গেছে (পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে) সেসবও আঁৎকে উঠার মত। ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ প্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে কয়েক’শ গুণ। স্ত্রীদের গয়না প্রতি ভরির মূল্য কারো ৩ হাজার, কারো ৫ হাজার, কারো ৭-৮ কিংবা ১০ হাজার। এসব তথ্য শুধু অবিশ্বাস্যই নয়। রীতিমত আইন, রাষ্ট্র ও জনগণের সাথে উপহাস ভিন্ন কিছু নয়।
অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনে সাকিব আল হাসান। কিছুক্ষন সোস্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চোখ পড়ে। গত রোববার (৩০ জুন ২০২৪) দুপুরে সিআইডি কার্যালয়ে ‘অনলাইন জুয়া ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা সাকিবের অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনে অংশ গ্রহণ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
সাকিব আল হাসানকে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে হবে কেন? কেন তাকে দুবাইতে গিয়ে হত্যা মামলায় দাগী আসামীর গোল্ডসপ উদ্বোধন করতে হবে? কেন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় মত্ত হবেন? কেন রাজনীতিবিদরা জনগণের সেবকের আসন থেকে প্রভূর আসনে আসীন হতে খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবর দখল, অর্থ পাচার, আদম পাচার, নারী কেলেংকারীর মত অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বেন?
এতোসব কেন’র উত্তর আমাদের জানা নাই। দেখছি শুধু চারিদিকে তামাশার আস্ফাল। কেউ যেন পিছিয়ে থাকতে চায়না অবৈধ উপার্জনের লালসা থেকে। এই অবৈধ সম্পদ অর্জনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির পথ কোথায়?
রাজনীতিবিদদের সততা এবং রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা ছাড়া এর থেকো উত্তোরণের অন্যকোন পথ অবশিষ্ট আছে বলে মনে করিনা। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা দুর্ণীতির অন্যতম পৃষ্ঠাপোষক। তারা রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে মুনাফাখোর, কালোবাজারি ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ নানান শ্রেণি পেশার ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ উপার্জনের সুযোগ করে দেয় এবং নিজেরাও ঘুষ চক্রে জড়িয়ে পড়ে। এ যেন আদাজলে রসুন সিদ্ধ খেলা।
মুক্ত ও স্বাধীণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে এই দুষ্ট ক্ষত থেকে উত্তোরণ অবশ্যই সম্ভব। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অন্যায় তোষণ ও চাপ বন্ধ করতে হবে। অপরাধীর জন্য কোন দলীয় বিবেচনা থাকতে পারেনা। কারণ অন্যায় যে করে আর যে সহে উভয় সমান অপরাধী। অপরাধীদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখাযায় প্রত্যেকের সরকার দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট। এরা রাজনৈতিক ছদ্দাবরণে দুর্ণীতির স্বর্গ রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছে। এইসব স্বর্গরাজ্যের মাস্টার মাইন্ডদের সাথে কোন না কোন রাজনৈতিক চরিত্র অবশ্যই জড়িত আছে। তাই সরকার যদি সর্বোতভাবে রাজনীতিকে দুর্ণীতি মুক্ত করতে পারে তবেই রাজনীতিতে সৎ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। যার সুফল সরকারি বেসরকারি সকল কার্যক্ষেত্রে উত্তমরূপে প্রতিফলিত হতে দেখা যাবে।
লেখক : চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।