মাওলানা রশিদ আহমদ শাহীন :
দুনিয়ার মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে যেসব নবী-রাসূলকে প্রেরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। আল্লাহতা‘আলাতাঁকেসমগ্রবিশে^র জন্য রহমত করে পাঠিয়েছেন (আম্বিয়া ২১/১০৭)।
তাঁর চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও দাওয়াতের ফলেই আমরা সত্যের দিশা পেয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনিই শাফা‘আত করবেন।এই মহামানবের প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাঁর জন্য দো‘আ করেন। আর তাঁর প্রতি দরূদ পাঠের জন্য সকল মুমিনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (আহযাব ৩৩/৫৬)।
এজন্য আমাদের দায়িত্ব হ’ল তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করাও তাঁর উচ্চমর্যাদার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।তাইরাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ছালাত ও সালাম পাঠ করা একটি গুরুত্ব্পূর্ণ ইবাদত। আর প্রত্যেকটি ইবাদত সম্পাদক করতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে রাসূল (সাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে। আলোচ্য প্রবন্ধে দরূদ পাঠের ফযীলত ও পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) পাঠের অর্থ
‘ছালাত’ শব্দটি কুরআন ও হাদীছে ব্যবহৃত একটি পরিচিত শব্দ।পবিত্র কুরআন ও হাদীছে ছালাত শব্দটি দু’টি ইবাদতকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি হ’ল, ‘ছালাত’ যা নামায হিসাবে উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত। আর দ্বিতীয়টি হ’ল, নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ‘দরূদ’পাঠকরা।আবুলআলিয়া (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর ক্ষেত্রে ছালাতের অর্থ ফেরেশতাদের সামনে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর প্রশংসা। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে ছালাতের অর্থ দো‘আ’।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী করীম (সা:)-এর প্রতি ছালাত হ’ল আল্লাহর রহমত, তাঁর সন্তুষ্টি এবং ফেরেশতাদের সামনে তাঁর প্রশংসা। আর ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে ছালাত হ’ল- নবী করীম (সাঃ)-এর জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করা এবং তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর উম্মতদের পক্ষ থেকে ছালাতের অর্থ হ’ল- তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর ব্যাপারে সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি।
আহমদ বিন ফারিস বলেন, ছালাত শব্দের অর্থ দো‘আ ব প্রার্থনা। …আর আল্লাহর পক্ষ থেকে ছালাত অর্থ- রহমত। হাদীছে এসেছে, ‘হে আল্লাহ! আবূ আওফার বংশধরের প্রতি সালাম বর্ষণ করুন’। অর্থাৎ রহমত বা করুণা করুন।
রাসূল (সা:)-এর উপর সালাম পাঠের অর্থ : ‘সালাম’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- শান্তি, নিরাপত্তা, অভিবাদন ইত্যাদি। রাসূল (সা:)-এর প্রতি সালামের অর্থ হ’ল- রাসূল (সাঃ)-এর জন্য আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করা। যেমন প্রত্যেক মুছল্লী ছালাতের ২য় ও শেষ বৈঠকে এই বলে নবী করীম (সাঃ)-কে সালাম প্রদান করেন, ‘আপনার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল হোক হে নবী’!
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) ও সালাম এক সাথে পেশ করা উত্তম। যেমনটি আল্লাহ নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। (অতএব) হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর’ (আহযাব ৩৩/৫৬)।
উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইবনু কাছীর (রহ:) বলেন, এই আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কদর, মান-সম্মান ও ইয্যত মানুষের নিকট প্রকাশ পেয়ে যায়। তারা যেন জানতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং রাসূলের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর ফেরেশতারা রাসূলের জন্য দো‘আ করে থাকেন। মালায়েআ‘লার এই খবর দিয়ে জগতবাসীকে আল্লাহ তা‘আলা এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারাও যেন তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাতে থাকে। যাতে আল্লাহর দরবারের ফেরেশতামন্ডলী ও দুনিয়াবাসীর মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়।
কোন কোন বিদ্বানের মতে, রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি শুধু ছালাত (দরূদ) পাঠ করা যায়। আবার শুধু সালামও পেশ করা যায়। কেননা রাসূল (সাঃ) প্রথমে ছাহাবীদেরকে শুধু সালাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ ছালাত (দরূদ) পাঠের নির্দেশ দেওয়ার পর রাসূল (সাঃ) ছাহাবীদেরকে দরূদ শিক্ষা দেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘জিব্রীল আমার নিকট এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি কি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন যে, আপনার প্রতিপালক বলেছেন, আপনার উম্মতের মধ্যে যে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করবে আমি তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করব। আর আপনার উম্মতের যে আপনার উপর সালাম পেশ করবে, আমি তার উপর দশ বার শান্তি বর্ষণ করব। আমি বললাম, হ্যাঁ অবশ্যই হে আমার রব’।
সুতরাং এক সাথে ছালাত ও সালম প্রদান করাই উত্তম। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি পাওয়া যায়। আর যার উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন আল্লাহ তাকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও রহমতের দো‘আ করে তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনার জন্য। বস্তুত: আল্লাহ ঈমানদারগণের প্রতি অতীব দয়ালু’ (আহযাব ৩৩/৪৩)।
শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘যখন রাসূল (সাঃ)-এর ছালাত ও সালাম একত্রিত হয় তখন চাহিদা পূরণ হয় এবং ভীতি দূর হয়। আর সালাম ভীতি দূর করে এবং অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে। আর ছালাত চাহিদা পূরণ করে এবং পরিপূর্ণতাকে নিশ্চিত করে’।
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের হুকুম : বিদ্বানগণের মতে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ছালাত (দরূদ) পাঠ কখনো ওয়াজিব আবার কখনো মুস্তাহাব। ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মতে তাশাহহুদের পর দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর ইমাম আবূ হানীফা ও মালেক (রহঃ)-এর মতে সুন্নাত।
হানাফী ও মালেকী মাযহাব মতে সূরা আহযাবের ৫৬নং আয়াতের আদেশ অনুযায়ী জীবনে একবার হ’লেও দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। ইমাম তাহাবী (রহঃ) বলেন, যখনই রাসূল (সাঃ)-এর নাম আসবে তখনই তার প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর মুস্তাহাব হ’ল, হাদীছে উল্লেখিত বিভিন্ন সময়ে। যেমন জুম‘আর দিনে, মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়, আযানের পরে, দো‘আর শুরুতে ইত্যাদি।
দরূদ পাঠের ফযীলত : নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা তাঁর উম্মতের প্রতি অবশ্য পালনীয় একটি ইবাদত। এই ইবাদত পালনের মাধ্যমে দরূদ পাঠকারী অনেক ছওয়াবের অধিকারী হয়ে থাকে, যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে। নিমেণ কয়েকটি ফযীলত উল্লেখ করা হ’ল-
১. আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত লাভ : দরূদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন’। রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের সাথে যদি সালাম প্রদান করা হয় তাহ’লে আল্লাহর পক্ষ থেকে দশটি শান্তি অবতীর্ণ হয়। এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য রহমত। তিনি বান্দার সকল ভাল কাজকেই ১০ গুণ করে বৃদ্ধি করেন (আন‘আম৬/১৬০)।
আব্দুর রহমান বিন আওফ (রা:) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাইরে যান, আর আমি তাঁকে অনুসরণ করি। তিনি একটি খেজুরের বাগানে প্রবেশ করেন এবং সিজদা করেন। তিনি সিজদারত অবস্থায় অনেক সময় অতিবাহিত করেন, ফলে আমি ভয় পেয়ে যাই এই ভেবে যে, সিজদারত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল কি-না? এজন্য আমি কাছে এসে লক্ষ্য করি। তিনি মাথা তুলে বললেন, আব্দুর রহমান, তোমরা কী হয়েছে? তখন আমি আমার (মনের ভয়ের) কথা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেন, জিব্রীল আমাকে বললেন, আপনি কি এ ব্যাপারে খুশি নন যে, আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনার উপর যে দরূদ পাঠ করবে আমিও তার উপর রহমত, বরকত নাযিল করব, আর যে আপনার উপর সালাম পাঠাবে আমি তার উপর শান্তি বর্ষণ করব’। (নবীকরীম (সাঃ) বলেন) ‘আর এজন্য আমি শুকরিয়ার সিজদাকরি’।
২. ফেরেশতা কর্তৃক আল্লাহর কাছে রহমতের জন্য দো‘আ : রাসূল (সাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠকারীর জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে থাকেন।রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা জুম‘আর দিন আমার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ কর। কারণ কিছুক্ষণ পূর্বে জিব্রীল তাঁর প্রতিপালক আল্লাহর নিকট থেকে আগমন করে বললেন, (হে নবী!) পৃথিবীর বুকে যে কোন মুসলিম তোমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করবে, আমি তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করব এবং আমার ফেরেশতাবর্গ তার জন্য দশ বার ক্ষমা প্রার্থনা করবে’। তিনি আরো বলেন, ‘যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে এবং যতক্ষণ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠরত থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য দো‘আ করতে থাকেন। অতএব বান্দা চাইলে তার পরিমাণ (দরূদপাঠ) কমাতেও পারে বা বাড়াতে ওপারে’।
৩. পাপ মোচন, ছওয়াব ও মর্যাদা লাভ : রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ গুনাহ মাফ, ছওয়াব ও মর্যাদা লাভের অন্যতম মাধ্যম। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, (তার বিনিময়ে) সেই ব্যক্তির উপর আল্লাহ দশটি রহমত বর্ষণ করেন, তার দশটি পাপ মোচন করেন এবং তার দশ ধাপ মর্যাদার স্তর উন্নীত করেন’।
৪. ক্বিয়ামতের দিন মর্যাদা লাভ : দুনিয়াতে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি যারা যত বেশী দরূদ পাঠ করবে ক্বিয়ামতের দিন তারা রাসূল (সাঃ)-এর তত বেশী নিকটবর্তী হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে যে আমার উপর সবচেয়ে বেশী দরূদ পড়ে’।
৫. রাসূল (সাঃ)-এর শাফা‘আত লাভ : দরূদ পাঠের আরেকটি ফযীলত হ’ল ক্বিয়ামতের দিন রাসূল (সাঃ)-এর শাফা‘আত লাভ করা। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল অথবা আমার জন্য ‘অসীলার’ দো‘আ করল ক্বিয়ামতের দিন তার ব্যাপারে শাফা‘আত করা আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে’। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা মুয়ায্যিনের আযান শুনলে তার উত্তরে সেই শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করবে। আযান শেষে আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে এবং এর পরিবর্তে আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। এরপর আমার জন্য আল্লাহর কাছে ‘ওয়াসীলা’ প্রার্থনা করবে। ‘ওয়াসীলা’ হ’ল জান্নাতের একটি উঁচু স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু একজন পাবেন। আর আমার আশা আমিই হব সেইজন। তাই যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওয়াসীলা’র দো‘আ করবে, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য সুফারিশ করা আমার উপর আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে’।
৬. জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা লাভ : জান্নাতে উচ্চমর্যাদা লাভের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠের কোন বিকল্প নেই। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যত বেশী আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তি (জান্নাতে) মর্যাদায় তত বেশী আমার নিকটবর্তী হবে’।
৭. ফেরেশতারা রাসূল (সাঃ)-এর কাছে দরূদ পৌঁছান : দুনিয়াতে রাসূলের উপরে কেউ দরূদ পাঠ করলে বা সালাম পেশ করলে ফেরেশতারা তা রাসূল (সাঃ)-এর কাছে পৌঁছে দেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ভ্রমণরত বহু ফেরেশতা রয়েছেন, যারা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমাকে সালাম পৌঁছে দেন’।
অন্যত্র রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ কর। কেননা আল্লাহ আমার কবরের কাছে ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। যখন আমার উম্মতের কোন লোক আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে, তখন ফেরেশতা আমাকে জানায় যে, নিশ্চয়ই অমুকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি এই সময়ে দরূদ পাঠ করেছে’।
অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর কবরের উপর একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে থাকেন এবং যখনই কেউ দরূদ পাঠ করে তখনই তাকে বলেন, হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! অমকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, এই দরূদ পাঠের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর কবরের কাছে যাওয়া শর্ত নয়; বরং বিশে^র যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সময় দরূদ পাঠ করলেই রাসূল (সাঃ)-এর কাছে তা পৌঁছানো হয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমার কবরকে উৎসব কেন্দ্রে পরিণত করো না। তোমরা আমার প্রতি দরূদ পেশ কর। কারণ তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের পেশকৃত দরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়’।
মুসলিম সমাজে বর্তমানে ধর্মের নামে আলেম-ওলামার কবরকে কেন্দ্র করে যে অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে সেগুলোর কোনটিই জায়েয নয়। এজন্য রাসূল (সাঃ) সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নবী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছিল। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি’।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, যখন রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি নিজের মুখমন্ডলকে চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলতে লাগলেন। আবার অসস্তিবোধ করলে তা চেহারা থেকে সরিয়ে ফেলতেন। এ অবস্থায় তিনি বললেন, ‘ইহুদী ও নাছারাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে’।
৮. রাসূল (সাঃ) কর্তৃক সালামের জবাব দান : কেউ যদি সালাম পেশ করে তাহ’লে রাসূল (সাঃ) সেই সালমের জবাব দেন। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন আমার উপর সালাম পেশ করে, তখন আল্লাহ আমার মধ্যে আমার আত্মা ফিরিয়ে দেন, ফলে আমি তার সালামের জবাব দেই’।
৯. দরূদ পাঠের মাধ্যমে চিন্তা দূর হয় : রাসূল (সাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠের কারণে চিন্তা দূর হয় এবং পাপ মোচন হয়। উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকেবর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার উপর অনেক বেশী দরূদ পাঠ করি। আপনি আমাকে বলে দিন, আমি (দো‘আর জন্য যতটুকু সময় বরাদ্দ করে রেখেছি তার) কতটুকু সময় আপনার উপর দরূদ প্রেরণের জন্য নির্দিষ্ট করব? উত্তরে নবী করীম (সাঃ) বললেন, তোমার মন যা চায়। আমি আরয করলাম, যদি এক তৃতীয়াংশ করি? নবী করীম (সাঃ) বললেন, তোমার মন যা চায়, যদি আরো বেশী কর তাহ’লে তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আমি আর য করলাম, যদি অর্ধেক সময় নির্ধারণ করি? নবী করীম (সাঃ) বলেন, তোমার মন যা চায়। যদি বেশী নির্ধারণ কর তাহ’লেতাতোমারজন্যইভাল।আমিবললাম, যদি দুই-তৃতীয়াংশ করি। নবী করীম (সাঃ) বললেন, তোমার মন যা চায়। যদি আরো বেশী নির্ধারণ কর তা তোমার জন্যই কল্যাণকর হবে। আমি আরয করলাম, তাহ’লে আমি আমার (দো‘আর) সবটুকু সময়ই আপনার উপর দরূদ পাঠ করার জন্য নির্দিষ্ট করে দেব? নবী করীম (সাঃ) বললেন, ‘তাহ’লে তোমার চিন্তা ও ক্লেশের জন্য তা যথেষ্ট হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করা হবে’।
১০. দরূদ পাঠের দ্বারা অন্তর পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় : রাসূল (সাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করলে অন্তর পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমার প্রতি দরূদ পাঠ কর। নিশ্চয়ই আমার উপর তোমাদের দরূদ তোমাদের (অন্তরের) পবিত্রতা। আর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট ‘ওয়াসীলা’ চাও’।
১১. দো‘আ কবুল হয় : হামদ ও ছানা তথা আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (সাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করার পরে দো‘আ করা হ’লে তা কবুল হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ছালাত আদায় করছিলাম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে আবু বকর ও ওমর (রাঃ)ও উপস্থিত ছিলেন। আমি (শেষ বৈঠকে) বসলাম, প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করলাম, তারপর নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করলাম, তারপর নিজের জন্য দো‘আ করলাম।নবী করীম (সাঃ) বললেন, ‘তুমি প্রার্থনা করতে থাক, তোমাকে দেয়া হবে; তুমি প্রার্থনা করতে থাকে তোমাকে দেয়া হবে’। অপরদিকে দরূদ পাঠ না করে দো‘আ করলে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দো‘আ দরূদ পাঠ না করা পর্যন্ত আড়াল করে রাখা হয়’।
লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা, ফেনী।