আরিফ আজম :
অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ফেনী জেলায় রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিট্যান্স) আয় হচ্ছে। প্রবাসী অধ্যুষিত এ জেলায় বছরের পর বছর অর্থনৈতিক সক্ষমতার পাশাপাশি মানুষের জীবনমানও বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত¡ ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণ বেশি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুমিল্লা ও সিলেট জেলা আয়তনে বড় হওয়ায় সেখানে রেমিট্যান্স আসে বেশি। জেলা হিসেবে ফেনী আয়তনে ওইসব জেলা থেকে ছোট হলেও প্রবাসীর সংখ্যা এই জেলায় তুলনামূলক বেশি। বৈধ চ্যানেলের পাশাপাশি অবৈধ চ্যানেলেও কোটি কোটি টাকা রেমিট্যান্স আসে এই জেলায়। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে ফেনী এক অনন্য উচ্চতায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ফেনীতে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় হার গড়ে ১০৫ টাকা ধরলে চলতি অর্থবছরে ফেনীর প্রবাসীরা ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ফেনীর প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৫১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ৫৭ কোটি ৬৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স ফেনীর প্রবাসীরা দেশে পাঠান।
জনশক্তি অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছর গত ৫ মাসে ফেনী জেলায় প্রবাসী সংখ্যা ৯ হাজার ১শ ২০ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২২১৯, ফেব্রæয়ারিতে ১৯৪৩, মার্চে ১৯৩৪, এপ্রিলে ১৩৬৩ ও মে ১৬৬১ জন বিদেশ গেছেন। এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই জেলার লাখ লাখ রেমিট্যান্স যোদ্ধা অবস্থান করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের ফেনী শাখায় এক লাখ গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে ৭০শতাংশ প্রবাসে থাকেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে এই শাখায় রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এখানে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৪১ কোটি টাকা। প্রায় দশ বছর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরেও এখানে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৬৮ কোটি টাকা। তুলনামূলক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও আশপাশের জেলার তুলনায় ফেনী এগিয়ে রয়েছে বলে ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
অপরদিকে চলতি বছর ২০২৩ সালের প্রথম ৫ মাসে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৮ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালে এসেছে ১৫৯ কোটি টাকা।
রেমিট্যান্স হিসাবে আসা অর্থের একটি অংশ জমা থাকছে ব্যাংকগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ফেনী জেলায় ব্যাংকের শাখাগুলোয় জমা ছিলো ১৪ হাজার ৫১২ কোটি টাকার আমানত। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা ছিলো শহর অঞ্চলে। বাকি ৪ হাজার ৪৯ কোটি টাকার আমানত ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা ব্যাংকের শাখাগুলোয় জমা আছে। মাথাপিছু আমানত স্থিতির দিক থেকে দেশে ফেনী জেলার অবস্থান একেবারেই সামনের সারিতে। তবে ফেনী জেলায় এখনো ব্যাংক ঋণের সম্প্রসারণ সে অর্থে হয়নি। জমাকৃত আমানতের এক চতুর্থাংশ অর্থও ফেনীতে বিনিয়োগ হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে ওঠে এসেছে।
দেশের আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ ফেনী জেলায় অবৈধ হুন্ডির তৎপরতা ভয়াবহ মাত্রার। এ কারণে জেলাটির বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিপরীতে বাড়ছে কালো টাকার অবাধ দৌরাত্ম। হুন্ডি তৎপরতার বিস্তারে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততারও প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি।
ইসলামী ব্যাংক ফেনী শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সানাউল্যাহ ফেনীর সময় কে জানান, অন্য ব্যাংকে রেমিট্যান্স ট্যাক্স বেশি হলেও সহজে সেবা পাওয়ায় ইসলামী ব্যাংকে গ্রাহকদের আগ্রহ বেশি। হয়রানী মুক্ত নির্বিঘেœ সেবা দিতে এ ব্যাংকের কর্মকর্তাগণ আন্তরিকতার সাথে নিরলস কাজ করছেন।
সোনালী ব্যাংক ফেনী প্রিন্সিপাল অফিসের ডিজিএম হারুনুর রশিদ ফেনীর সময় কে জানান, ডলার সংকটের কারণে সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে ট্যাক্স বেশি দেয়ায় গ্রাহকরা সেখানেই লেনদেন করেন। তারপরও প্রান্তিক পর্যায়ে সোনালী ব্যাংকের শাখা থাকায় এখানে রেমিট্যান্স লেনদেন গ্রাহকদের সহজ হয়।
ফেনী জেলা ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জোন প্রধান সামছুল করিম মজুমদার ফেনীর সময় কে বলেন, বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো হলে ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের সমৃদ্ধি বাড়ে। এজন্য প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে সরকারিভাবে আড়াই শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে।
ফেনী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি আয়নুল কবির শামীম ফেনীর সময় কে বলেন, প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছেনা। অথচ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি আরো গতিশীল হতো তেমনিভাবে ভবিষ্যত প্রজন্মও উপকার ভোগ করার সুযোগ পেতো।