সজল কান্তি বণিক :
আপনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটা স্বপ্নে তলিয়ে আছেন। এমন সময় কোন একটা যন্ত্র আপনাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে খাটে বসালো। আপনি বিরক্ত সহকারে মেশিনটির দিকে তাকাতেই মনে করিয়ে দিলো, এটি একটি রোবট। আপনার ক্রয়কৃত রোবটিকে রাতে শোয়ার সময় প্রোগ্রাম সেট করে রাখলে সে সকালে ৬টা নাগাদ ঘুম থেকে তুলে দেয়া এবং সকাল ৯টায় গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজগুলো করে থাকে। তবে রোবটিক্সের কল্যাণে সেই অবিশ^াস্য ব্যাপারটাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে সত্য হতে যাচ্ছে। হয়তো আর বেশি দেরি নেই। আমাদের সবারই হয়তো পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে থাকবে এমন একটা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা রোবট। রোবট হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের অনুরূপ কর্মকাণ্ড করতে পারে। এটি তৈরি হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিতে। আজকের দিনের অধিকাংশ রোবটই বায়ো-ইন্সপায়ার্ড রোবটিক্স ক্ষেত্রটি দ্বারা উৎসাহিত হয়ে তৈরি। রোবটিক্স-এর সাধারণ বিষয়গুলো বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ প্রযুক্তিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত এবং কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবট মেশিন তৈরি করে যা মানুষের ন্যায় কাজ করে থাকে।
‘রোবটিক্স’ শব্দটি এসেছে ‘রোবট’ শব্দ হতে যা প্রবর্তিত হয় চেক লেখ ও নাট্যকার কারেল কাপেক এর একটি নাটক হতে যেটি ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়। রোবট শব্দটি মূলতঃ এসেছে সøাভিক রোবটা হতে, যার অর্থ হলো ‘শ্রমিক’।
আইজ্যাক অ্যাসিমভ রোবটিক্সের তিনটি নিয়ম, বিধি-বিধান বা আইনের কথা তুলে ধরেন। নিয়ম-১: রোবট কখনোই কোনো মানুষের ক্ষতি করবে না অথবা উদাসীন বা অপ্রবৃত্তির মাধ্যমে কাউকে ক্ষতির সুযোগ দিবে না। নিয়ম-২: প্রথম নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে রোবট সবসময় মানুষের নির্দেশ মেনে চলবে। নিয়ম-৩: রোবট অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে যতক্ষণ না প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। মানব কল্যাণে রোবট তৈরি করা হয়, মানুষের ক্ষতির জন্য নয়। তাই রোবট তৈরির ক্ষেত্রে এই নিয়ম বা আইন মেনে চলা হয়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাতা থেকে বেরিয়ে প্রথম সত্যিকার রোবটটি তৈরি করেন আমেরিকান উদ্ভাবক জর্জ চার্লস ডেভল। ১৯৫০ সালে তার তৈরি প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের নাম ছিল ইউনিমেট। কিন্তু এই রোবট তৈরির প্রজেক্টের উদ্যোক্তা ছিলেন আরেক আমেরিকান জোসেফ ফ্রেডরিক এঞ্জেল বার্গ। রোবট তৈরির টেকনিক্যাল বিষয়ে তার অবদান না থাকলেও এবং তৈরিকৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটটি পেটেন্ট চার্লস ডেভল এর নামে থাকলেও উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মান প্রদর্শনের জন্য এঞ্জেলবার্গকেই রোবোটিক্সের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে গবেষণা নকশা ও নতুন নতুন রোবট তৈরির ফলে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে তা সে ঘরো বাণিজ্যিক বা সাময়িক কাজই হোক না কেন সব কাজেই রোবটকে ব্যবহার করা হয়। কিছু কিছু রোবট শুধু প্রোগ্রাম অনুসারেই কাজ করে, আবার কোনোটিকে দূর থেকে লেজার রশ্মি বা রেডিও সিগন্যালের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একটি রোবটে সাধারণত বিভিন্ন উপাদান বা অংশগুলো থাকতে পারে।
মুভেবল বডি- স্থানান্তরিত হবার জন্য একটি রোবটে চাকা, যান্ত্রিক সংযোগ সম্পন্ন পা কিংবা অন্য কোনো ধরনের নড়াচড়া করাতে সক্ষম যন্ত্রপাতি যুক্ত থাকে।
অ্যাকুচুয়েটর- এমন এক ধরনের মোটর যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘোরানো বা যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মস্তিষ্ক বা প্রসেসর- রোবটের মস্তিষ্ক রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইলেকট্রিক সার্কিট- ইলেকট্রিক সার্কিট বৈদ্যুতিক রোবটের মোটরসমূহ বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদান করে। অনুভূতি- রোবটের অনুভূতির জন্য হাত বা পায়ের কোনো জায়গায় স্পর্শ করলে যে জায়গা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। রোবটিক্স- এর ব্যবহারসমূহ হলো ম্যানুফ্যাকচারিং-এ কম্পিউটার এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিং এ রোবটিক্স ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে যানবাহন ও গাড়ি কারখানায় রোবট ব্যবহৃত হয়।
বিপজ্জনক কাজে যে সমস্ত কাজ করা স্বাভাবিকভাবে মানুষের জন্য বিপজ্জনক সেক্ষেত্রে রোবটিক ডিভাইস ব্যবহৃত হয়। শিক্ষা, গবেষণা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ও সার্জারির কাজে রোবটের সহায়তা করে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসেবে পাইলট/ড্রাইভারের বিকল্প হিসেবে এ রোবট ব্যবহার করা হয়। মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে রোবটের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
রোবটিক্সের গুরুত্ব আলোচনা করতে গেলে বলতে হয় আগামী উন্নত বিশে^ রোবট বা রোবটিক্স এক বিপ্লবের নাম। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আগামী বিশে^ রোবট হবে মানুষের একমাত্র পথ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফেনী সাউথ-ইস্ট কলেজ।