রিন্টু আনোয়ার :
শিক্ষা দুই অক্ষরের শব্দ। কিন্তু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান, পঠন-পাঠন, কারিকুলাম-পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি মিলিয়ে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বহু বিষয়াদি। পরিস্থিতির বাস্তবতা বা ভাগ্যের ফেরে শিক্ষার প্রতিটি উপাদানেই গোলমাল-বিভ্রাট। কখনো কখনো বিভ্রমও। আজ এটা, কাল সেটা। এই সিরিয়ালে এখন জেন্ডার বিভ্রান্তি। কারিকুলাম গণ্ডগোলের মাঝেই সামনে এসেছে শরীফ-শরীফা ক্যাচাল।
নতুন কিছু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু, এ নিয়ে অসহিষ্ণুতা দুদিকেই। কারিকুলামসহ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যেখানে খোদ একজন সদ্য সাবেক মন্ত্রীও সমালোচনা করেছেন, সেখানে সমালোচনা করার অপরাধে ৪ জন অভিভাবককে গ্রেফতার করে সরকার তার অবস্থান জানিয়েছে। সন্তান কোন পদ্ধতিতে পড়বে ,তা নিয়ে বলতে গিয়ে অভিভাবককে গ্রেফতার হতে হবে। এর মাঝে আবার জেন্ডার বিষয়ে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চাকরি খোয়া গেছে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। এক আচানক বা অভিশপ্ত কাণ্ডকীর্তি। কোথায় গিয়ে লাগাম পড়বে এই শনির আছরে।
সন্তানদের লেখাপড়া ও মানুষ হবার প্রক্রিয়া পুরোটাই এখন সরকারের মর্জির ওপর। জাত আমলা এবং শিক্ষক-আমলারা যা বানিয়ে দেন, তা-ই গেলাতে হয় সন্তানদের। সেই ধারায় নতুন পাঠ্য বইয়ের ভুল-ভ্রান্তি, নকলবাজি ও আজগুবি কনটেন্টের ছড়াছড়ি। গুগুল থেকে নামিয়ে কপিপেস্ট করে দেয়ার খামখেয়ালিও বাদ যায়নি। প্রায় প্রতি বছর শেষে তা সহ্য করা যেন নিয়তি। এরপর যোগ হয় কারিকুলাম। এখন এসে ঠেকেছে পাঠ্যসুচিতে কদাকারভাবে জেন্ডার সংযোজনে। সরকারের দিক থেকে যখন যা করা হয় সবই শুদ্ধ। বোর্ড স্ট্যান্ড, স্টার, ডিভিশন শুদ্ধ। জিপিএ পদ্ধতি আরো শুদ্ধ। সৃজনশীল-এমসিকিউ সব পদ্ধতির এই শুদ্ধাশুদ্ধির মাঝে এখন শরীফ-শরীফাও শুদ্ধ। এতো শুদ্ধ হজম করতে আজাবের মতো এক বাধ্যবাধকতা। সেইসঙ্গে এ বিষয়ক গবেষণা-প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের হাজার কোটি কোটি টাকা ব্যয়। এ কর্মে যারপরনাই দ্রুততা ও ব্যস্ততা। হুলস্থুলে লুকোচুরির মানসিকতা।
রাজনীতি, দল, ক্ষমতা আগেও পরিবর্তন হতো তবে পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন ভালো উদাহরণ নয়। আবার বিগত পনেরো বৎসরতো আর দল পরিবর্তন হয়নি তবে কেন শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন? কেন এতো দিনের গবেষনায় তৈরি হতে পারেনি সর্বজন স্বীকৃত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা। তাই বলে মৌলিক অধিকারের অন্যতম শিক্ষা নিয়ে ? এই কোমলমতি শিশুদের নিয়ে রাজনীতি না করলেই কি নয় ? তা আবার জেন্ডার দিয়েও করতে হবে? সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের আলোচিত ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে এনটিসিবির সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধন করা হবে মর্মে মন্ত্রীর আশ্বাস, কমিটি গঠনে আপাতত পরিস্থিতি হয়তো চাপা রাখা যাবে। কিন্তু, এটি কি আদৌ কোনো ফয়সালা? প্রশ্নের জবাব না মেলায় প্রতিক্রিয়াও আসছে দুঃখজনক আবহে। মন্ত্রীর উপরোক্ত আশ্বাস ও কমিটি গঠনের আগে রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডার একটি গল্পের (শরীফার গল্প) পাতা জনসম্মুখে ছিড়ে ফেলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক আসিফ মাহতাব। জাতীয় শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে পাঠ্যপুস্তকের দুটি পাতা ছেড়েন তিনি।
বইয়ে ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ঢুকিয়ে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন মাহতাব। এ সময় সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের ৮০ টাকা দিয়ে বইটি বাজার থেকে কিনতে বলেন তিনি। পরে বইয়ের ট্রান্সজেন্ডারের গল্প থাকা দুটি পাতা ছিঁড়ে আবার দোকানে ফেরত দিতে বলেন। এ ঘটনার পর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মাহতাব লেখেন, ‘আজকে আমি ব্র্যাকে রেগুলার ক্লাস নিয়েছি। আমাকে এইমাত্র ফোন করে জানানো হয়েছে যে, আমি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ক্লাস নিতে না যাই। আমি জানি না হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত তারা কেন নিল। আমাকে কোনো কারণ তারা দেয়নি।’ পরে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। আসিফ মাহতাবকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে দেন। বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে তা নিয়ে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেন, ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে এনটিসিবির সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধন করা হবে। আবার এও বলেন, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই যারা কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা করছেন তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। শিক্ষা কারিকুলামে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।
প্রশ্ন আবারও। একদিকে সংশোধনের আশ্বাস আরেকদিকে ‘রাতারাতি সংশোধন’ করা যাবে না মর্মে জানান দেয়ার অর্থ কী দাঁড়ালো? গোলমাল থেকেই গেল। হিজড়া মানে ট্রান্সজেন্ডার; ট্রান্সজেন্ডার মানেই হিজরা-এমন বুঝ আর খাটছে না। গোলমালটার শুরু উন্নত বিশ্ব থেকে। ধীরে ধীরে যার শিকার হতে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। মাত্রাগতভাবে বাংলাদেশ আরেকটু বেশি ঝুঁকিতে। সাম্প্রতিক ধাক্কাটা এসেছে গণতন্ত্রের পাদপীঠ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে মন্তব্য থেকে। তিনি বলেছেন ‘কেউ চাইলেও লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না’ অথবা ‘পুরুষ পুরুষই, নারী নারীই’। কথা অন এভারেজ হলেও তার এ মন্তব্য নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন। বিশ্ব এমন একটা সময় পার করছে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের সংসদে বিতর্কের বিষয় হয়- ‘পুরুষ কি গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারে?’ এ বছরের শুরুতে জেলখানায় জন্মগত পুরুষ এক ট্রান্সজেন্ডার নারী প্রকৃত নারী রুমমেটকে ধর্ষণের ইস্যুতে স্কটল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হন। স্কুলের পাঠ্যক্রমে ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি মতাদর্শ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে কানাডায় বিক্ষোভ করেছেন লাখ লাখ মা-বাবা।
যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনেও ট্রান্সজেন্ডার একটি বড় ইস্যু হতে যাচ্ছে। তুরষ্কের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বড় ইস্যু ছিল এলজিবিটি। মূল্যবোধ রক্ষার্থে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অবস্থানও ট্রাডিশনাল এলজিবিটির বিরুদ্ধে। চীনের একই মনোভাব। সেখানে এলজিবিটি গোষ্ঠীর প্রাইড মাসে রঙধনু পতাকা বহনের অপরাধে কয়েকজনক গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার শব্দের মৌলিক তফাৎ না বোঝায় ২০১৮ সালে পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডার বিল পাস হয়। কিন্তু জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে মনস্ত্বাত্তিক জেন্ডার পরিচয় অন্তর্ভুক্তির কারণে সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বিধায় কোর্ট পরে আইনটি বাতিল করে। সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখতে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর অবস্থানও এলজিবিটির বিরুদ্ধে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শে বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে। জেন্ডার আইডেন্টিটি ইস্যুতে ইতালিতেও তোলপাড়। এর মাঝে বিশ্ব সেরা টেক বিলিনিয়ার ইলন মাস্কও ট্রান্সজেন্ডারের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে আরেক আবহ তৈরি করে দিয়েছেন। অভিভাবকদের সচেতন করতে এ বিষয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে পোস্টও দেন তিনি। এসবের মধ্য দিয়ে ট্রান্সজেন্ডার বড় রকমের ইস্যু গোটা বিশ্বে।
জেন্ডার হচ্ছে সামাজিক বা মনস্ত্বাতিক পরিচয় যার সাথে বায়োলজির উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নেই। মার্কিনি এই বুঝও আবার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া, বর্তমানে জেন্ডার আইডেন্টিটি ফিল্ডে মানসিকতা ও ব্যাখ্যায় পরিবর্তনশীলতার এক ধুম চলছে। বাংলাদেশও পড়ে গেছে এ বাড়তি বা উটকা ঝামেলায়। বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা অধিকার খসড়া আইনে ট্রান্সজেন্ডারের ডেফিনেশন গ্লোবাল এলজিবিটি মুভমেন্টের অনুকরণে গ্রহণ করা হয়েছে। আত্ম-অনুভূত পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যা ব্যক্তির জৈবিক পরিচয়ের বিপরীত। ট্রান্সজেন্ডার শব্দের সাথে হিজড়া বা ইন্টারসেক্স গোষ্ঠীকে যুক্ত করায় অনেকে বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। এ নিয়ে মিডিয়াগুলোও আক্রান্ত। তা নামে-শিরোনামেও। হাজার হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক সিস্টেম ওলোট-পালটের তর্ক-বিতর্ক। ঘুরছে স্যোশালমিডিয়ার সঙ্গে মেইন স্ট্রিমের মিডিয়ায়ও। তা পাঠ্যপুস্তকে উঠে আসায় আলোচনা-সমালোচনা পেয়েছে নতুন মাত্রা।
থার্ড জেন্ডার আর ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে গোলমালের মাঝে ট্রান্সজেন্ডার মানে কি, তা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির শরীফ থেকে শরিফা হয়ে ওঠার গল্পে। বিষয়টি যেভাবে আলোচনায় এসেছে তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন। তার শঙ্কা, শরীফ থেকে শরিফা হওয়ার গল্পটি অল্প বয়স থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মগজ ধোলাইর মতো। এ মগজ ধোলাইর মাধ্যমে বাচ্চারা সমকামিতার দিকে ঝুকবে বলে শঙ্কা তার। গল্পটিতে ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা এবং হিজড়াদের প্রতি বৈষম্য না করার প্রতি দিকনির্দেশনা দেওয়া। একে ইতিবাচক ভাবারও জায়গা আছে। কিন্তু, গল্পের উপস্থাপনা, ভাষা-শব্দ-বাক্য মোটেই যথাযথ নয়। গোলমালটা বেশি পেকেছে এ কারণেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।