দৈনিক ফেনীর সময়

সংস্কারের কঠিন কাজে ড. ইউনূসের নরম হাত

সংস্কারের কঠিন কাজে ড. ইউনূসের নরম হাত

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্র্বতী সরকারের দায়িত্বে আসার পর এটা জাতির উদ্দেশে তার দ্বিতীয় ভাষণ। এর আগে গত ২৫ আগস্ট প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি।

ধ্বংস হয়ে পড়া একটা জনপ্রশাসনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন উল্লেখ করে তার ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘মন্ত্রণালয়গুলোর উচ্চতম পদে যারা নিয়োজিত ছিলেন তারা অনেকে দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেছেন কিংবা পদে থাকলেও সহকর্মীদের চাপের মুখে কাজ করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন। শুরুতে কিছু না বললেও এসব বিষয়ে এখন একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেছেন ড. ইউনূস। দ্বিতীয় ভাষণে এসে বলেছেন আরো বেশি করে। পুরো ভাষণটি পড়লে বা শুনলে এই উপলব্ধিতে আসা যায়, সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আর বলার কিছু বাকি নেই। জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় ভাষনে এসে সব বলে দিয়েছেন। এর আগে প্রথম ভাষণে কিছু বিষয় বাকি বা অসমাপ্ত ছিল। সংবাদ সম্মেলন এবং নানা অনুষ্ঠানে এক এক বিষয়ে বলেছেন। দ্বিতীয় ভাষণে এসে সবিস্তারে সব বলেছেন। তার ইমামতিতে রাষ্ট্র মেরামতের ছয় কান্ডারির ছয় কমিশনের কথাও জানিয়েছেন। লোক বাছাইতেও দেখিয়েছেন বেশ ক্যারিশমা। এই বিশিষ্ট ৬ জনের নতুন করে খুব বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে না। সেই কবে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাথা ঠুকরে চলছেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। নির্বাচন বিষয়ক কমিশনের কাণ্ডারির দায়িত্ব তাকেই দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ক প্রচুর হোম ওয়ার্ক বদিউর রহমানের। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি জীবন্ত কিংবদন্তি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ানোর আহ্বান ও তাগিদের ফেরিওয়ালা টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামানকে দেয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব। পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব সফর রাজ হোসেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আর সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান শাহদীন মালিক। এই হাফ ডজন ব্যক্তিত্বের দায়িত্ব বন্টনে একটা প্রশ্নের কিঞ্চিত ফয়সালাও হয়ে গেল। প্রশ্ন ছিল-সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা? মানে সংস্কারের বটম লাইন হবে কোথায়? কোন জায়গা বা ক্ষেত্র দিয়ে শুরু হবে কাঙ্খিত সংস্কারটি? প্রশ্নটির জবাব মিলছিল না। তাদের দায়িত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে মোটামোটি খোলাসা হয়েছে কোনো জায়গাই বাদ দেয়া হবে না। নির্বাচন, সংবিধান, বিচার, দুর্নীতি দমন, সিভিল-পুলিশ ৬টি বিভাগেই মেরামত চলবে। আর এই কটি সেক্টরে সংস্কার হলে তেমন কিছু বাকি থাকে না।

জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় ভাষণে ড. ইউনূস মন ভরিয়ে দিয়েছেন সাংবাকিদের। আগে বরেছিলেন ভুল-ত্রুটি পেলে ধরিয়ে দিতে। এবার বলেছেন, ‘মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন’। ‘মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন বলে জানিয়েছেন। তার মানে কোনো হেরফের না হলে, গণমাধ্যমের জন্যও একটি কমিশন অত্যাসন্ন। এই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গড়া ’জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এ’ দান করতে দেশের সকল মানুষ এবং বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বন্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত মাসে ফেনী-কুমিল্লা-নোয়াখালী সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা এসব এলাকার মানুষকে হতভম্ব করে দিয়েছে। এখানে বেশিরভাগ এলাকায় কোনোদিন বন্যা হয়নি। তারা বন্যা মোকাবিলায় অভ্যস্ত নন।

সাদামাটা কথায় বন্যা আক্রান্তদের রক্ষায় সশস্ত্রবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে নেমে আসার প্রশংসা করেছেন। বন্যা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সৈনিক এবং অফিসারদের দিনের পর দিন দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এর কোনো তুলনা হয় না। বিশেষভাবে এনেছেন এনজিওদের কথাও। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনো উন্নত হয়নি তা বলেছেন অকপটে। তার বাসভবন ঘেরাওকথা টেনেছেন। তার ভাষায়: যেসমস্ত ভাই-বোনরা তাদের গত ১৬ বছরের বেদনা জানিয়ে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমার অফিস এবং সচিবালয়ের অফিসগুলোর সামনে প্রতিদিন ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে আমাদের কাজকর্ম ব্যাহত করছিলেন, তারা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘেরাও কর্মসূচি থেকে বিরত হয়েছেন বটে, তবে অন্যত্র আবার তারা তাদের কর্মসূচি দিয়ে যাতায়াতে ব্যাঘাতও সৃষ্টি করেছেন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাব না। আমরা সকল অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের দায়িত্বকালে যথাসম্ভব সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। আমি আবারও অনুরোধ করছি, আপনারা যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি থেকে বিরত থাকুন। জাতি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। প্রশংসা করেছেন তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প এসব এলাকায় কর্মরতদের।

ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য একসঙ্গে অনেকগুলো কাজের কথাও জানান তিনি। পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনকে দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল, এর মধ্যে হত্যা মামলা ছাড়া বাকি প্রায় সকল মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃত সকলে মুক্তি পেয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বিচার বিভাগের বড় সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। যোগ্যতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়াতে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগসহ অনেকগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ এবং অন্যান্য নিয়োগ সবকটাই শেষ হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল কালো আইনের তালিকা করা হয়েছে। অতি সত্বর এ সকল কালো আইন বাতিল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ বহুল আলোচিত পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তার কথাও জানিয়েছেন। গুম থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে সইয়ের কথাও আছে ভাষণে।

ভাষণের এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ উভয়ের সঙ্গেই তার টেলিফোন যোগাযোগ আছে। তথ্য হিসেবে এটি চমৎকার। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে চান বলেও জানিয়েছেন। কাজটি কি খুব সোজা? পতিত সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে আরেক জায়গায় বলেছেন, … ‘স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অহেতুক কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখেছি যেগুলো কখনোই দেশের মানুষের জন্যে ছিল না, বরং এর সঙ্গে জড়িত ছিল কুৎসিত আমিত্ব এবং বিশাল আকারের চুরি। চলমান এবং প্রস্তাবিত সকল উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর যাচাই-বাছাই করার কাজ আমরা শুরু করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায় বিবেচনা করে বাকি কাজে ব্যয়ের সাশ্রয় এমনকি প্রয়োজনবোধে তা বাতিল করার কথা বিবেচনা করা হবে’। কথাগুলো আশা জাগানিয়া। জনআকাঙ্খাও। কিন্তু, বাসস্তবায়ন কদ্দুর সম্ভব? লুটপাট ও পাচার হয়ে অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টার কথাও জানিয়েছেন ড. ইউনূস।

ভাষণে এসেছে বিদ্যুত খাতে চুরি-দুর্নীতির কথাও। দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের অধীন চলমান সকল প্রকার নেগোসিয়েশন, প্রকল্প বাছাই এবং ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। গত দেড় দশকে এই আইন ব্যবহার করে লাখো কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোম্পানিগুলোতে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার লক্ষ্যে কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতে যেন উজ্জ্বল হয়, সেটা নিশ্চিত করতে শিক্ষাব্যবস্থার দিকও বাদ যায়নি তার বক্তৃতায়। সেইসঙ্গে আলোকপাত করেছেন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। সেখানে এসেছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম নেয়ার কথা। ফ্যাসিবাদী সরকার লুটপাট করার জন্য নতুন করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার কারণে দেশের মানুষ মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে উল্লেখ করে ইউনূস বলেছেন, এই অতুলনীয় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্র্বতী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

আগে কেবল আওয়ামী মতাদর্শী না হওয়ার কারণে ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত অনেক প্রার্থী নিয়োগ বঞ্চিত হওয়ার কথাও আছে ভাষনটিতে। ভাষণের অনেক জায়গায় আওয়ামীলীগ সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। কিন্তু তার অনেক উপদেষ্টা এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের ফ্যাসিষ্ট, ফ্যাসিবাদ এবং বিপ্লব শব্দগুলো উচ্চারণে বেশ দ্বিধা। তা হলে বলার আর বাকি থাকলো কী? ড. ইউনূস ভয় পান না। তার উপদেষ্টাদের ভয় পেলে চলবে না। সরকারের শক্তি সুসংহত করার দায়িত্ব সকল উপদেষ্টাদের। এর বাইরে যাওয়ার কোনো অপশন নেই। সেখানে যোগ হয়েছে ৬ সংস্কার কমিশন প্রধানের নামও। তাদের কারোই ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা ব্যর্থ হলে আর অবষ্টি কিছু থাকবে না। সেই আলোকে কঠিন কাজে হাত দিয়েছেন ড. ইউনূস।

আমরা মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা যে সময়োপযোগী ভাষণ দিয়েছেন এবং নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। মাঠ প্রশাসনকে জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক ভাবে গড়ে তোলাসহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!