পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে আপন হলো সন্তান। আর সন্তানের জন্য সবচেয়ে আপন হলো পিতা-মাতা। পিতার-মাতার জন্য সন্তান শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, তদ্রƒপ সন্তানের জন্যও পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। সুতরাং সন্তানকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা ও দ্বীনদারূপে গঠন করা। সন্তানকে সত্যিকার মানুষ করতে না পারলে এমন সন্তান দ্বারা পিতা-মাতার কোন লাভ হবে না, না দুনিয়ায়, না পরকালে। তাই তাদেরকে সুন্দরভাবে প্রতিপালন করা এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা আবশ্যক। শুধু দোয়া নয়, মনীষীদের মতো সাত বছর পর্যন্ত এদের সাথে খেলা করা, পরবর্তী সাত বছর প্রশিক্ষণ দেয়া, তৃতীয় সাত বছর সঙ্গ দেওয়া তারপর তাদের দায়িত্ব তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বিনা কারনে প্রহার করা, ধমক দেয়া, কড়া নজরে রাখা উচিত নয়। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী হয়। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া এবং পিতা-মাতার জন্য সন্তানের কবুল করা হয়।
সন্তানের জন্য দোয়া : নবী-রাসূলগণ সন্তানের জন্য দোয়া করেছেন। হযরত ইবরাহীম আ. কে যখন আল্লাহ তা’য়ালা মানব জাতির ইমাম হিসেবে ঘোষণা দেন, তখন তিনি এ বলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে দোয়া করেছিলেন – হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য নেতা (সূরা ফুরকান: ৭৪)। তিনি আরো দোয়া করেন- হে আমাদের রব! তাদের কাছে তাদের মধ্য হতে এমন একজন বার্তাবাহক প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে, আপনার আয়াত সমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন। (সূরা বাকারা: ১২৯)। হযরত ইবরাহীম আ. এর দোয়ার ফসল হযরত মুহাম্মদ সা. এর প্রেরণ। আল্লাহ তা’য়ালা সন্তানকে শিখিয়েছেন পিতা-মাতার জন্য দোয়া করতে। যেমন- হে আমাদের প্রতি পালক! যে দিন হিসাব-নিকাশ অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে আর মু’মিনদেরকে ক্ষমা করে দিন (সূরা- ইবরাহীম : ৪১)। আরো ইরশাদ করেন- হে আমার প্রতিপালক! তাদের (পিতা-মাতার) প্রতি রহম করুন, সেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন – পালন করে ছিলেন (সূরা- বনী ইসরাঈল: ২৪)। পিতা-মাতার কাম্য হওয়া উচিত যেন তাদের সন্তান-সন্ততি দ্বীনদার ও চরিত্রবান হয়। নবী-রাসূলগণ স্বীয় সন্তানদেরকে হিতোপদেশ দিয়েছেন। হযরত লুকমান হাকিমের কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদের উল্লেখ করেছেন। যেমন- ১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। ২. নামায কায়িম করবে। ৩. মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দিবে আর অসৎ কর্ম বিরত রাখবে এবং বিপদে আপদে ধৈর্যধারণ করবে। ৪. অহংকারবশত মানুষকে অবজ্ঞা করবে না এবং অহংকার করবে না। ৫. প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ স্বরে কথা বলবে না (সূরা লুকমান)।
হযরত ইয়াকুব প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- তোমরা কি উপস্থিত ছিলেন যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন সে সন্তানদের বলল, আমার পর তোমার কার ইবাদাত করবে? তারা বলল, আমরা আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের ইবাদাত করব। তিনি একক উপাস্য এবং আমরা তাঁর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পিত (সূরা বাকার- ১৩৩)।
মহানবী (সা) এর দোয়া : মহানবী সা. সাহাবীদের নবজাত শিশুদের কোলে নিয়ে খেজুর চিবিয়ে মিষ্টি রস তাদের মুখে দিতেন এবং তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. জামাতা আলী রা. কন্যা ফাতিমা রা. ও নাতী হাসান ও হোসাইন রা. এর জন্য দোয়া করেছেন। একদা হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাঈন রা. কে এক সঙ্গে একত্রিত করে বলেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত তথা পরিবার তাদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভ‚ত করে তাদেরকে পবিত্র করুন (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং- ৬১৩৫)।
হযরত আয়েশা রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সা. একদা সকালে পশমের তৈরী চাদর গায়ে জড়িয়ে বের হন। অতঃপর হাসান ইবন আলী আসলে তাকে চাদরের নীচে স্থান দেন, তারপর হুসাইন আসলে তাকেও স্থান দেন, তারপর ফাতিমা আসলে তাকেও চাদরের নীচে স্থান দেন। অতঃপর বলেন- হে আহলে বাইয়াত! আল্লাহ তা’য়ালা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং পরিচ্ছন্ন করতে (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং ৬১৩৬)। হযরত বারা ইবন আযেব বলেন, আমি হাসান ইবন আলী রা. কে রাসূল সা. এর কাঁধে দেখেছি। তিনি তখন বলছেন, হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। হযরত উসামা ইবন যাদের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী সা. একদা হাসান ও হুসাইন রা. কে ধরে বলেন হে আল্লাহ ! আমি তাদের ভালবাসি, আপনিও তাদেরকে ভালবাসুন (সহীহ বুখারী)। মহানবী সা. অন্যত্র বলেছেন- হে আল্লাহ! আমি হাসান হুসাইনকে ভালবাসি, আপনিও তাদেরকে ভালবাসুন এবং যারা তাদেরকে ভালবাসে আপনি তাদেরকেও ভালবাসুন (তিরমিযী)। আরো বলেছেন- হুসাইন আমার অংশ, আমি হুসাইনের অংশ। হুসাইনকে যে ভালবাসবে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। হুসাইন আমার নাতী (তিরমিযী)। সকল সাহাবীর কল্যাণের জন্য রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করেছেন। কয়েকজনের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছেন। হযরত ইবন আব্বাস রা. বলেন- মহানবী সা. আমাকে তাঁর বক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরে দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে প্রজ্ঞা দান করুন (সহীহ বুখারী, মিশকাত হাদীস নং ৬১৪৭)।
হযরত ইবন আব্বাস রা. আরো বলেন- একদা রাসূলুল্লাহ সা. শৌচাগারে প্রবেশ করলে আমি নীরবে অজুর পানি রেখে আসি। তিনি শৌচাগার থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করেন, এ পানি কে রেখেছে? তখন আমার কথা বলা হলে তিনি আমার দোয়া করেন, হে আল্লাহ! তাকে দ্বীনের তত্ত¡জ্ঞান দান করুন (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম মিশকাত হাদীস নং- ৬১৪৮)। হযরত আবু বকর রা. প্রসঙ্গে বলেন- আল্লাহ আবু বকরের প্রতি রহম করুন। সে তার কন্যাকে আমার কাছে বিয়ে দিয়েছে, তার বাহনে করে হিজরত করিয়েছে, গারে সাওরে আমার সাথী হয়েছে, স্বীয় মাল ব্যয় করে বিলালকে আযাদ করেছে। আল্লাহ ওমরের প্রতি রহম করুন! সে তিক্ত হলেও সত্য কথা বলেছে। আল্লাহ ওসমানের প্রতি রহম করুন! ফেরেশতাও তাকে দেখে লজ্জাবোধ করে। আল্লাহ আলীর প্রতি রহম করুন! হে আল্লাহ! সে যেখানেই, থাকুক সত্যকে তার সাথী করে দিন (তিরমিযী, মিশকাত হাদীস নং ৬১৩৪)। রাসূল সা. বলেছেন, হে আল্লাহ! আবদুর রহমান ইবন আওফকে জান্নাতের শীতল পানি পান করান (আহমদ)। রাসূল সা. একদা দোয়া করেন, হে আল্লাহ! আবু হুরায়রা ও তার মাকে আপনার মুমিন বান্দাহদের প্রিয় করে দিন এবং মু’মিনদেরকেও তাদের প্রিয় করে দিন (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং- ৬২১৩)। আনসার ও মুহাজিরের জন্য দোয়া করতে গিয়ে রাসূল সা. বলেন- হে আল্লাহ! আপনি আনসার, মুহাজির,তাদের সন্তান ও তাদের সন্তানদের সন্তানকে ক্ষমা করে দিন (মুসলিম)। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন কালে আনসার ও মুহাজিরের জন্য দোয়া করেন- হে আল্লাহ! আনসার ও মুহাজিরদেরকে ক্ষমা করে দিন (বুখারী)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।