দৈনিক ফেনীর সময়

সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ও পিতা- মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য

মাওলানা রশিদ আহমদ শাহীন :

আল্লাহ তায়লা মানব জীবনকে সন্তান-সন্তানির মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষনীয় করেছেন। পারিবারিক জীবনে সন্তান সন্তানি কতবড় নেয়ামত তা যার সন্তান হয়নি তিনি সবচেয়ে বেশী উপলদ্ধি করে থাকেন। যাদের কে আল্লাহ তায়লা সন্তান দান করেছেন তাদের যাদের কে আল্লাহ তায়লা সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে আদর্শবান রূপে গড়ে না তুলতে পারেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন প্রত্যেক মানব শিশুই ইসলামী ফিতরাতের উপ জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহুদি নাসারা অথবা অগ্নিপূজক হিসাবে গড়ে তোলে। পিতা-মাতার পরিচালনার দোষেই সন্তান সন্তনি পথ হারা হয়। সন্তান আল্লাহ তায়লার পক্ষ হতে আমানত। প্রত্যেক পিতা মাতার জন্য সন্তানের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া জরুরী। পিতা মাতার অবহেলার কারণে সন্তানের জীবন যদি সুন্দর না হয় এর জন্য কিয়ামতের কাঠ গড়ায় দাড়াতে হবে। মানবজাতী এ পৃথিবীতে বড়ই অসহায়, নিতান্তই এটি পূর্ণ ও অক্ষম। তাই যদি দুনিয়ার লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে এ অমূল্য জীবনকে বৃথা কাজে নষ্ট করে তাহলে কাল কেয়ামতের কঠিন ময়দানে শূকর ও কুকুর থেকেও নিকৃষ্ট বিবেচিত হবে। কারণ শূকর ও কুকুরতো সেদিন মাটিতে মিশে গিয়ে জাহান্নাামের ভয়াবহ কঠিন শাস্তি থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র মানুষ ও জ্বীন জাতি নিজ কর্মদোষে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। পিতা মাতা হলেন সন্তাানের প্রথম অভিভাবক, প্রথম শিক্ষক। আর তার পরিবার তার ১ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদি এ প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে তাহলে সন্তানের ভবিষ্যৎ হবে। উজ্জল এবং সুন্দর। তাই এক্ষেত্রে পিতা মাতাকে উন্নত ভূমিকা রাখতে হবে। পিতা মাতার ভূমিকা না থাকায় অধিকাংশ সন্তান অকালে ঝড়ে পড়ে। সন্তানকে আদর্শ হিসাবে গড়ে তুলতে পিতা মাতাকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।

১। সন্তানকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান প্রদান করা।
২। সন্তানের সাত বছর বয়স হলে তাকে নামাজের আদেশ দেওয়া।
৩। সন্তান কে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা।
৪। আদর্শ নৈতিকতা বোধ সম্পর্ণ মানবে পরিণত করা।

পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য ও অসন্তুষ্টির পরিণাম : পিতা-মাতা আমাদের জন্মদাত্রী, পিতা-মাতার সমতূল্য আপনজন পৃথিবীতে আর নাই। পিতা-মাতা যাদের মাধ্যমে একজন সন্তান এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখে। মহান আল্লাহ তায়লা তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়লা তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন পিতা মাতার প্রতি সদ্ব্যব্যবহার কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবনদ্দশায় বাধর্কে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উহ শব্দটি বলনা এবং তাদের কে ধমক দিওনা এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল পিতা এবং মাতাকে কষ্ট দিলে তার কোন ইবাদত কবুল হবে না।

পিতা-মাতাকে অসন্তুষ্ট করার পরিণাম : ইমাম তাবরানী ও ইমাম আহমদ একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা:) এর যুগে আলকামা নামে মদীনায় এক যুবক বাস করতো। সে নামায, রোযা ও সদকার মাধ্যমে আল্লাহ তায়লার ইবাদত বন্দেগীতে অতিশয় অধ্যবসায় সহকারে লিপ্ত থাকতো। একবার সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তার স্ত্রী রাসূল (সা:) এর কাছে খবর পাঠালো যে, “আমার স্বামী আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় আছে। হে রাসূল, আমি আপনাকে তার অবস্থা জানানো জরুরী মনে করছি।” রাসূল (সা:) তৎক্ষণাৎ হযরত আম্মার, সুহাইব ও বিলাল (রা:) কে তার কাছে পাঠালেন। তাদেরকে বলে দিলেন যে, “তোমরা তার কাছে গিয়ে তাকে কালেমায়ে শাহাদাত পড়াও।” তারা গিয়ে দেখলেন, আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় রয়েছে। তাই তারা তাকে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়াতে চ্ষ্টো করতে লাগলেন। কিন্তু সে কোন মতেই কলেমা উচ্চারণ করতে পারছিল না। অগত্যা তারা রাসূল (সা:) কে খবর পাঠালেন যে, আলকামার মুখে কলেমা উচ্চারিত হচ্ছে না। যে ব্যক্তি এই সংবাদ নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে রাসূল (সা:) জ্ঞিাসা করলেন : “আলকামার পিতামাতার মধ্যে কেউ কি জীবিত আছে ?” সে বললো : “হ্যা রাসূল, তার কেবল বৃদ্ধা মা বেঁচে আছে।” রাসূল (সা:) তৎক্ষণাত তাকে আলকামার মায়ের কাছে পাঠালেন এবং বললেন : ‘তাকে গিয়ে বল যে, তুমি যদি রাসূর (সা:) এর কাছে যেতে পার তবে চল, নচেত অপেক্ষা কর, তিনি তোমার সাথে সাক্ষাত করতে আসছেন।” দূত আলকামার মায়ের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূল (সা:) যা বলেছিলেন তা জানালে আলকামার মা বললেন : রাসূল (সা:) এর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক। তার কাছে বরং আমিই যাবো।” বৃদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে রাসূল (সা:) এর কাছে এসে সালাম করলেন।

রাসূল (সা:) সালামের জবাব দিয়ে বললেন: “ওহে আলকামার মা, আমাকে আপনি সত্য কথা বলবেন। আর যদি মিথ্যা বলেন, তবে আল্লাহর কাছ থেকে আমার কাছে ওহি আসবে। বলুন তো, আপনার ছেলে আলকামার স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল ?” বৃদ্ধা বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল, সে প্রচুর পরিমাণে নামায, রোযা ও সদকা আদায় করতো।” রাসূল (সা:) বললেন : তার প্রতি আপনার মনোভাব কী ? বৃদ্ধা বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল, আমি তার প্রতি অসš‘ষ্ট।” রাসূল (সা:) বললেন, “কেন ?” বৃদ্ধা বললেন:, সে তার স্ত্রীকে আমার ওপর অগ্রাধিকার দিত এবং আমার আদেশ অমান্য করতো।” রাসূল (সা:) বললেন: “আলকামার মায়ের অসন্তোষ হেতু কলেমা উ”চারণে আলমাকার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।” তারপর রাসূল (সা:) বললেন: “হে বিলাল, যাও, আমার জন্য প্রচুর পরিমাণে কাষ্ঠ যোগাড় করে নিয়ে এস।”

বৃদ্ধা বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল, কাষ্ঠ দিয়ে কী করবেন ?” রাসূল (সা:) বললেন: “আমি ওকে আপনার সামনেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব।” বৃদ্ধা বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল (সা:) আমার সামনেই আমার ছেলেকে আগুন দিয়ে পোড়াবেন। তা আমি সহ্য করতে পারবো না।” রাসূল (সা:) বললেন : “ওহে আলকামার মা, আল্লাহর আযাব র্এ চেয়েও কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এখন আপনি যদি চান যে, আল্লাহ আপনার ছেলেকে মাফ করে দিক, তাহলে তাকে আপনি মাফ করে দিন এবং তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। নচেত যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ তার কসম, যতক্ষণ আপনি তার ওপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, ততক্ষণ নামায-রোযা ও সদকা দিয়ে আলকামার কোন লাভ হবে না।” একথা শুনে আলকামার মা বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহকে, আল্লাহর ফেরেশতাদেরকে এবং এখানে যে সকল মুসলমান উপস্থিত তাদের সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি আমার ছেলে আলকামার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি।” রাসূল (সা:) বললেন : “ওহে বিলাল, এবার আলকামার কাছে যাও। দেখ, সে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে পারে কিনা। কেননা, আমার মনে হয়, আলকামার মা আমার কাছে কোন লাজ-লজ্জা না রেখে যথার্থ কথাই বলেছে।” হযরত বিলাল (রা:) তৎক্ষণাত গেলেন। শুনতে পেলেন, ঘরের ভেতর থেকে আলকামা উচ্ছ্বস্বরে উচ্চারণ করছে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। অতঃপর বিলাল গৃহে প্রবেশ করে উপস্থিত জনতাকে বললেন ঃ শুনে রাখ, আলকামার মা অসন্তুষ্ট থাকার কারণে সে প্রথমে কালেমা উচ্চারণ করতে পারেনি। পরে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার জিহ্বা কলেমা উচ্চারণে সক্ষম হয়েছে। অতঃপর আলকামা সেই দিনই মারা যায় এবং রাসূল (সা:) নিজে উপস্থিত হয়ে তার গোসল ও কাফনের নির্দেশ দেন, জানাযার নামায পড়ান এবং দাফনে শরীক হন। অতঃপর তার কবরে দাঁড়িয়ে রাসূল (সা:) বলেনঃ “হে আনসার ও মুহাজেরগণ! যে ব্যক্তি মায়ের ওপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দেয় তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও সকল মানুষের অভিসম্পাত! আল্লাহ তার পক্ষে কোন সুপারিশ কবুল করবেন না। কেবল তওবা করে ও মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করে তাকে সন্তুষ্ট করলেই নিস্ত পার পাওয়া যাবে। মনে রাখবে, মায়ের সš‘ষ্টিতেই আল্লাহর সন্তোষ এবং মায়ের অসন্তোষেই আল্লাহর অসন্তোষ।”

লেখক : অধ্যক্ষ, তাযকিয়াতুল উম্মাহ মডেল মাদ্রাসা, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!