নিজস্ব প্রতিনিধি :
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার সোনাগাজীতে ১১৫টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ে মাটিতে ন্যুয়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে ৭০ হেক্টর জমির ফসল। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর-মাছের খামার। গাছপালা ভেঙ্গে বিদ্যুতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার উপকূলীয় চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫-৪০ হাজার মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্তসহ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনজুরুল হক ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: ইকবাল হাসান।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেন, উপজেলায় প্রাথমিক তথ্য হিসেবে প্রায় ৩৫-৪০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ১১০টি বাড়ি আংশিক ও ৫টি ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে ইন্টারনেট সেবা ও মেবাইল নেটওয়ার্ক সেবা জনিত ত্রুটির কারনে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। ওই চূড়ান্ত তালিকায় ক্ষতির পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠে থাকা ৬৫ হেক্টর আমন ধান এবং ৫ হেক্টর সবজির ক্ষতি হয়েছে। ধানগাছগুলো ঝড়ো বাতাসে ভেঙ্গে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা বলেন, উপজেলার চর দরবেশ, চর চান্দিয়া, সদর ও আমিরাবাদ এ চারটি ইউনিয়নে প্রায় ১০০ একর জায়গার শতাধিক পুকুর ও খামারের মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। এতে করে প্রায় দেড় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সোনাগাজী জোনাল অফিসের ডিজিএম প্রকৌশলী সনৎ কুমার ঘোষ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৮০টি স্থানে ৩৩ হাজার কেভি লাইনের ওপর গাছ পড়ে তার ছিড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া সিত্রাংয়ের তান্ডবে বিভিন্ন এলাকায় গাছ ও গাছের ডালপালা ভেঙ্গে বিদ্যুতের লাইন ও খুঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১০টি খুটি ভেঙ্গে পড়েছে। এছাড়া ১২টি ট্রান্সফরমার বিকলসহ ৮-১০টি পুল নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো মেরামতে কাজ চলছে। পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। তবে মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে কয়েকটি ফিডারে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্য্যে ছিল।
এদিকে উপজেলার নদী উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে সোমবার রাতে জোয়ারের সময় প্রায় ৮-৯ ফুট পানি উঠেছে। অনেক এলাকায় বাঁধ ও সড়ক উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছিল। তবে মঙ্গলবার ভোর নাগাদ অধিকাংশ এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আতঙ্কে আশ্রয়কেন্দ্রে অর্ধরাত কাটানোর পর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ জোয়ারের পানি নেমে গেলে তারাও বাড়ি ফিরে যান। তবে সকাল পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে কোন লোকজন ছিলেন না।
উপজেলার আজিজুল হক মায়মুন আরা উচ্চবিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে ছেলে ও ছোট নাতিকে নিয়ে উঠেছেন বৃদ্ধা জোবেদা বেগম। তিনি বলেন, তার বাড়ি বড় ফেনী নদী সংলগ্ন চর খোন্দকার এলাকায় ‘যেভাবে ঝড় আসতেছে আর বাতাস হচ্ছে, তাতে যেকোনো সময় ঘর উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই মাইকিং শুনেই ছেলে ও ছোট নাতিকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসছেন।’ তবে গভীর রাতে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ায় তিনি সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে যান।
জেলে পাড়ার বাসিন্দা মদন জল দাস জানান, তিনি পেশায় একজন জেলে। মাছ শিকার করে জীবিকা চালান। ঋণের টাকা দিয়ে একটি ঘর তৈরী করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। সোমবার রাতে ঝড়ে তাঁর ঘরের চালা উড়ে নিয়ে গেছে।
চরচান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মিলন বলেন, ঝড় ও জোয়ারের পানিতে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও মাছ ভেসে গিয়ে তার ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনজুরুল হক বলেন, উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ৩৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৫হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারীদের মধ্যে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি রোধে উপজেলায় ১টি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ১৪টি মেডিকেল দল, পুলিশ, ফায়ার সাভির্সের সদস্য ও সিপিপির দুই হাজারসহ প্রায় আড়াই হাজার স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছেন।