দৈনিক ফেনীর সময়

সোনাগাজীতে নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাচ্ছে শতশত পরিবার

নিজস্ব প্রতিনিধি :

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর এবার সোনাগাজী উপজেলায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। ছোট ফেনী, কালিদাস পাহালিয়া ও মুহুরী নদীর ভাঙনে গত দুই সপ্তহে ঘরবাড়ি হারিয়েছে অন্তত দুইশতাধিক পরিবার। সাগরের পানি ভেতরে ঢুকায় এবং বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর বাড়িঘর ও সড়কের মাটি নরম হয়ে নতুন করে উপজেলার চর দরবেশ, চর মজলিশপুর, বগাাদানা,চর চান্দিয়া, নবাবপুর ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে পরিবারগুলো ঘর বাড়ি হারিয়ে কেউ খোলা আকাশের নিচে কেউবা স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। নদী গর্ভে বিনীন হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। নদীর তীর এলাকায় আজকে যে জায়গা দৃশ্যমান, কাল তা নিমিষেই নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভিটেমাটি হারিয়ে নি:স্ব হচ্ছে নদীপাড়ের বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা জানায়, গত ২০ আগষ্ট থেকে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও উজানের পানিতে ডুবে পুরো জেলায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এবন্যা প্রায় ১০দিনেও বেশি সময় স্থানীয় ছিল। এতে করে জেলার ছয়টি উপজেলার মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্নস্থাপনা পানির নিচে তলিয়ে অকেটা মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে ফেনীর বাসিন্দারা। গত ২৬ আগষ্ট পানির চাপে ভেঙে যায় নোয়াখালীর মুছাপুর রেগুলেট। পরদিন ছোট ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সাহেবেরঘাট সেতুর পশ্চিম অংশে সংযোগ সড়কের মাটি সরে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় নোয়াখালীর সঙ্গে সোনাগাজীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুছাপুর রেগুলেট ভেঙে যাওয়ায় সাগরের লবণাক্ত পানি এখন সহজে ভেতরে ঢুকে লোকালয়ে চয়ে যাচ্ছে। বন্যা ও সাগরের পানির চাপে গত ২ সেপ্টেম্বর উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকায় গ্রামীণ সড়কে ১০ দশমিক ৩মিটারের একটি সেতু ভেঙে বদর মোকাম খালে পড়ে গেছে। সাগরের পানি ঢুকায় এবং বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর বাড়িঘর ও সড়কের মাটি নরম হয়ে নতুন করে উপজেলার চর দরবেশ, চর চান্দিয়া, চর মজলিশপুর, বগাদানা, নবাবপুর ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

নবাবপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা শাহীনা আক্তার ও লাইনী আক্তার বলেন, আমরা দুই বোন জমিজমা না থাকায় মোবারকঘোনা- রঘুনাথপুর সড়কের পাশে বসবাস করে আসছি। বাড়ির একাংশ কালিদাস পাহালিয়া নদীর ভাঙনে নদীতে চলে গেছে। পাশের রাস্তাও ভেঙে গেছে। একটি ঘরের কিছু জিনিসপত্র অন্য এক বাড়িতে নিয়ে রেখেছি। কী করব বুঝতে পারছি না। স্বামী না থাকায় ছোট ছেঅট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকটা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছি।

একই এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, নদীর তীরে কোন রকম ভয়ে ভয়ে বসবাস করছি। বন্যা পরবর্তী সময় যেন আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি মুহুর্ত যেন সংকেত দিচ্ছে, কখন বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

চর দরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চর সাহাভিকারী গ্রামের বাঁশপাড়া এলাকায় স্বপরিবারে বসবাস করতেন গৃহবধূ আয়েশা আক্তার। কিন্তু মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার পর সাগর থেকে জোয়ারের পানি প্রবল স্রোতের কারণের তার বসবাসের ঘরটি আর নেই। ছোট ফেনী নদীর ভয়াল থাবায় মুহুর্তেই তাঁর ঘরটি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এখন নদীর পাড়ে তার ঘরের কোনো নিশানাও নেই। এদিকে বন্যার পানিতে গত ২০ আগস্ট থেকে অনেকটা ঘর ছাড়া অন্যদিকে সময়ের ব্যবধানে নিজের পিতার দেয়া ঘর বিলিন হয়ে যাওয়ায় শোকে কাতর আয়েশা আক্তার।

স্বামী জাকির হোসেন দিনমজুর। কোনো রকমে কাজ করে পরিবার চালাতো। কিন্তু তার আয় রোজগার বন্ধ। তিন মেয়ের মধ্যে দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে ছোট। পাশাপাশি একমাত্র ছেলে সন্তানও ছোট হওয়ায় সবদিকেই যেন আঁধার বাসা বেঁধেছে। শোকে যেন তাদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ফেনী নদীর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নদীর তীরে মাটিতে বসে আছেন আয়েশাসহ বাড়ীর কয়েকটি পরিবার। তবে অন্যান্য পরিবারের ঘর চোখে পড়লেও আয়েশার দৃশ্যমান ঘর নেয়। বিলিন হয়ে যায় নদীগর্ভে। সবাইকে চিন্তিত মনে হচ্ছে একমাত্র থাকার সম্বল কখন যে নদীতে বিলিন হয়ে যায়। পরিবারের ভরণপোষণের কষ্টের মধ্যে আয়েশার বাবা তাদের থাকার জন্য জায়গা ও ঘর করে দেন। ঘরের কিছু আসবাবপত্র রক্ষা করতে পারলেও হারিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। আয়েশার মতো ছোট ফেনী নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী অন্তত কয়েক হাজার পরিবার দুঃচিন্তায় রয়েছে। কখন যে তাদের ভিটা হারা হতে হয়। অনেকেই অন্যত্র চলে যাওয়ার পূর্ব প্রস্ততি নিয়ে রেখেছেন । নদীর তীরে বসবাস করা অসহায় পরিবার গুলোকে কাটাতে হচ্ছে নির্ঘুম রাত।

আয়েশা আক্তার বলেন, আমার বিয়ের কয়েকবছর পর আমার স্বামীর অসুস্থতার কারণে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমার পিতা জায়গা ও ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে এত বছর রয়েছি। কিন্তু মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের পানির প্রবল স্রোতের কারণে আমাদের বাড়ী-ঘর নদীতে বিলিন হয়ে যায়। এখন কি করবো বুঝতে পারছিনা।

নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর এলাকা বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, বন্যার পর পানি নেমে যাওয়ায় কালিদাস পাহালিয়া নদীর ভাঙনে তার বাড়ির তিনটি পরিবার নি:স্ব হয়ে গেছেন। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে তাঁরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

চর দরবেশ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, তার ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় ছোট ফেনী নদীর ভাঙনে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে নদী ভাঙন ঠেকানোর একমাত্র সমাধান হলো নদীতে চ্যানেল খনন করা। তাহলে পানির গতিপথ ঠিক থাকবে। তা না হলে অন্তত ৩০হাজার মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়ে নি:সব হয়ে যাবে।

ইবাবপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জহিরুল আলম বলেন, ভয়াবহ বন্যার পর পানি কমে যাওয়ায় তাঁর ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ডে কালিদাস পাহালিয়া ও মুহুরী নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সুলতানপুর, রঘুনাথপুর, ফতেহপুর, মজুপুর ও মোবারকঘোনা এলাকার বাসিন্দারা। গত দুই সপ্তাহের ভাঙনে অন্তত ২০০ পরিবার বাড়িঘর হারিয়ে নি:স্ব হয়ে গেছেন। পাশাপাশি রাস্তাঘাট ভেঙে এক এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষের যাতায়ত ও যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি দ্রুত নদী ভাঙন রোধ করে তাঁর ইউনিয়নের বাসিন্দাদেরকে রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

পাউবোর সেকশন কর্মকর্তা এ এম রকি বলেন, সোনাগাজী উপজেলার নদী ভাঙনের স্থানগুলো পরির্দশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর ও সাহেবেরঘাট সেতুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যাতে এবিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায় সে জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও ঘরবাড়ী বিলিন হওয়া পরিবারের সঙ্গেও প্রশাসনের যোগাযোগ করা হয়েছে। নদী ভাঙন রোধ এবং ক্ষতিগ্রস্থদের বিষয়ে আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবো।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!