দৈনিক ফেনীর সময়

১ হাজার হেক্টর কৃষি জমি বিলীন হুমকিতে ৩০ হাজার হেক্টর জমি

১ হাজার হেক্টর কৃষি জমি বিলীন হুমকিতে ৩০ হাজার হেক্টর জমি

নিজস্ব প্রতিনিধি :

বন্যা ও বৃষ্টির পানির চাপে ধসে পড়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর)। রেগুলেটরের স্লুইসগেট ভেঙে যাওয়ার ফলে কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদী হয়ে আসা উজানের পানি এবং চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, ফেনী সদর, দাগনভূঞা, সোনাগাজীর একাংশ এবং নোয়াখালীর সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জমে থাকা বন্যার পানি সন্দ্বীপ চ্যানেলে সহজেই নেমে যেতে পারছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারার আগেই মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে পড়ার প্রভাবে ছোট ফেনী নদী, সিলোনিয়া ও কালিদাস পাহালিয়া নদীতে পানির গতিবেগে একে একে বিলীন হচ্ছে নদীর তীরবর্তী ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। ছোট ফেনী এবং সিলোনিয়া নদীর তীরবর্তী ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিলীন হয়েছে ৪১ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। হুমকিতে ৩০ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ। ভাঙনের মুখে রয়েছে বাড়িঘর, বাজার, মসজিদ, শ্মশানসহ এলাকার প্রধান সড়ক। আগামী বর্ষার আগে ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে অন্তত হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। চরম ক্ষতির শিকার নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ। এতে ভাঙ্গনের আতংকে ১০ হাজার পরিবার। এ অঞ্চলের ক্ষতি হবে ১৭শ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছোট ফেনী নদীর কোম্পানীগঞ্জের দুই অংশে বালু উত্তোলন করা হতো। ছোটধলি এলাকায় বালু উত্তোলনে নেতৃত্ব দিতেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই শাহাদাত হোসেন ও মুছাপুরের আহসান উল্লাহ ভুট্টো মেম্বার। তাদের বালু কুমিল্লা পর্যন্ত যেত। অপর অংশে বালু উত্তোলন করতেন জালাল উদ্দিন। তিনি মুছাপুর এলাকাও নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই দুই অংশেই শেল্টার দিতেন মুছাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী এবং ওবায়দুল কাদেরের আরেক ভাই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। সোনাগাজী অংশে বালু উত্তোলন করতেন যুবলীগ নেতা সেন্টু ও জামশেদ আলম। ভাগ নিয়ে শেল্টার দিতেন সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন (বর্তমানে নুসরাত হত্যা মামলায় কারাগারে), আমিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিরন, চরদরবেশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভুট্টো ও চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মিলন।

পাউবো ফেনী সূত্রে জানা গেছে, ছোট ফেনী এবং সিলোনিয়া নদীর ভাঙন ঠেকাতে ৩০০ কোটি টাকা প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বাস্তবে নদী ভাঙন রোধে অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। এখনো পর্যাপ্ত বরাদ্দ না আসায় সকল নদী ভাঙন সংস্কার করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি দেবে গেছে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জোরারগঞ্জ সড়কের ছোটধলি ব্রিজও।

সোনাগাজী উপজেলার চর দরবেশ ইউনিয়নের সাহেবের ঘাট ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের সংযোগস্থল ছোট ফেনী নদী ওপর ২০১৮ সালে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটিতে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে গেছে নোয়াখালী-ফেনী-চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ সড়কের যাতায়াত। চরম ক্ষতির শিকার নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষ। এতে এ অঞ্চলের ক্ষতি হবে ১৭শ কোটি টাকা।

ফেনীতে ভাঙন কবলিত এলাকার মধ্যে রয়েছে চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদরবেশ, আদর্শগ্রাম, পশ্চিম চরদরবেশ, কাজীর সুইচ গেইট, তেল্লার ঘাট, ইতালি মার্কেট, ধনী পাড়া, চরচান্দিয়ার সাহেবের ঘাট, মোল্লার চর, পশ্চিম চরচান্দিয়া, কাদানানার আলমপুর, আউরারখিল, চর মজলিশপুর ইউনিয়নের চরবদরপুর, কুঠিরহাট
কাটা খিলা, কালি মন্দির, আমিরাবাদ ইউনিয়নের বাদামতলী, গুচ্ছগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম।

নদী ভাঙনের কবলে পড়েছেন চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চর সাহাভিকারী এলাকার আকলিমা আক্তার। ভাঙনে বসতভিটা ছেড়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ছেলেসন্তান ও অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তার। নদীর দিকে চেয়ে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই তার। তিনি বলেন, এ এলাকায় নদী ভাঙনে গত দুই মাসে অন্তত ৫০-৬০টি বসতি বিলীন হয়ে বাস্তুহারা হয়েছেন শতাধিক পরিবার। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছেন তারা।

আরেক ভুক্তভোগী আবুল কাসেম বলেন, সবাই এসে পরিদর্শন করে যায়, কিন্তু আমাদের দুঃখ ঘোচানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এখনো দেখিনি। ঘরবাড়ি সব নদীতে চলে গেছে এখন আমি রাস্তার পাশে ঘর করে আশ্রয় নিয়েছি। বাঁধ সংস্কার ও মুছাপুর রেগুলেটর নির্মাণ না করা হলে এ ভাঙন প্রতিরোধ করা যাবে না। সেটি দ্রুত করতে হবে, তাহলে আমাদের জীবন বাঁচবে। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে না জেলে সম্প্রদায়ের শ্মশান ঘর, চলাচলের সড়কসহ তাদের ঘরবাড়ি। একে একে চোখের সামনে বিলীন হচ্ছে সব। সড়ক ভেঙে যাওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে বন্ধ রয়েছে যাতায়াত। মুছাপুর রেগুলেটর পুনর্র্নিধসঢ়;মাণ না করলে এ সমস্যা সমাধান হবে না বলে মনে করছেন তারা।

সানজিদা আক্তার নামে একজন বলেন, নদী ভাঙনে ইতোমধ্যে আমার রান্নাঘর ধ্বসে পড়েছে। ঘরের পাশে শ্মশান সেটিও ভেঙে যাবে এক দুইদিনের মধ্যে। রাতে জোয়ারের পানি আসলে ঘরে বুক পর্যন্ত ওঠে। ছোট বাচ্চা নিয়ে ঘরে থাকা যায় না। রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় কোম্পানিগঞ্জের সাথে যোগাযোগ বন্ধ, কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

নদী ভাঙন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চরদরবেশ ইউনিয়নের নদীর পাড়ের বাসিন্দা মান্নান, জুলাস, জাকের হোসেন, আবুল কাসেম, খুরশিদ, বশর, হারুন, আলেয়া, আবুল কালাম, ফেরদৌস, হালিম, নুর নবী, রফিক, দরবেশ, আতর আলি, লতা মালেক, ওহিদ, বাবলু, ইব্রাহিম, হেনা মিয়া, আবু তাহের এবং শাহ আলমসহ অন্তত ৬০-৭০টি পরিবার গত দেড় মাসে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছেন। তারা সকলে কৃষি জমি হারিয়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

জসিম উদ্দিন কাঞ্চন বলেন, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড অল্প বরাদ্দ প্রদান করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ছোট ফেনী নদীর মুছাপুর থেকে শুরু হয়ে সোনাগাজী ও দাগনভূঞা পর্যন্ত অন্তত ২০টি স্থানে নদীতে বাঁক রয়েছে। ওই বাঁকগুলো সোজা করা হলে এবং ভেঙে যাওয়া মুছাপুর ক্লোজার ড্যামের কাছাকাছি স্থানে নতুন করে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হলে বিস্তীর্ণ জনপদ রক্ষা পেতে পারে।

সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ফেনীর সময় সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, মুছাপুর রেগুলেটরটি ভাঙার অন্যতম দুটি কারণ দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা রেগুলেটরের ৫০ থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে বালি তুলে শত শত কোটি টাকার বালি ব্যবসা করেছেন। ফলে এই রেগুলেটরের গোড়ার ভিত্তি দুর্বল হয়েছে এবং ভাঙার মতো এই ভয়ানক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক বালুদস্যুরা জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উচ্চপদে থাকা লোকজনকে ম্যানেজ করেই এ ব্যবসা চালিয়েছে। এই বালিদস্যুদের অপকর্মের ফলে কিছুদিন আগে মুছাপুরে বিএডিসির পাঁচ কিউসেকের একটি সোলার সেচপাম্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

তিনি আরো বলেন, রেগুলেটরের পাশের ছোট ফেনী নদী ১১০০ মিটার প্রশস্ত। অথচ এই রেগুলেটরটি ছিল ২৩ ভেন্টের। যেটা মাত্র ৯০ মিটার প্রশস্ত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গরমের দিনে গরম বেড়েছে এবং বর্ষাকালে বর্ষার তীব্রতাও বেড়েছে। ২০০৫-২০১০ সালের হিসাবে রেগুলেটরের ৯০ মিটার প্রস্ত হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে ১১০০ মিটার নদীর পানি এই ৯০ মিটার রেগুলেটরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার কারণে পানির চাপ ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। এটাও এই রেগুলেটর ভাঙার অন্যতম একটা কারণ। ভবিষ্যতে এ বিষয়টিও পুন:নির্মাণের সময় বিবেচনায় রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: হালিম সালেহী বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার পর থেকে নদী ভাঙনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি ও অতি বৃষ্টির চাপ নিতে না পারার কারণে স্লুইসগেটটি ভেঙে গেছে। এর ফলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, ফেনী সদর, দাগনভূঞা, সোনাগাজীর একাংশ এবং নোয়াখালীর সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একাংশে জমে থাকা বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারবে। পাশাপাশি সাগরে যখন বেশি জোয়ার হবে, তখন নোনা পানিতে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে। নতুন করে মুছাপুর রেগুলেটর এবং ক্লোজার না করা পর্যন্ত ভাঙন রোধে ¯’ায়ী সমাধান হবে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, আগামী বর্ষা পর্যন্ত এটি তৈরি করার সম্ভাবনা নেই। ততদিন কার্যক্রম থামিয়ে না রেখে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হবে। কারণ ব্লকের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান করতে হবে, তার আগে যেভাবে চেষ্টা করা যায় সেটি অব্যাহত আছে।

পাউবো সূত্র জানায়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় সাগরের লোনাপানি যেন না ঢোকে এবং শুষ্ক মৌসুমে যেন কৃষির জন্য পানি ধরে রাখা যায় সেজন্য সাগরের মুখে ছোট ফেনী নদীতে ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ব্যয়ে এই ক্লোজার ও ২৩ ভেন্ট রেগুলেটর নির্মাণ করা হয় ২০০৫ সালের ৮ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ছোট ফেনী নদীতে ‘মুছাপুর রেগুলেটর’ এর ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করেন। ২০০৯ সালে রেগুলেটরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। নির্মাণের ১৫ বছর না যেতেই রেগুলেটরটি ভেঙে পড়ল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!