Untitled-1

ইউশা’র জন্য প্রার্থনা

কিশান মোশাররফ :
আঙ্কেল খেজুর খান। আমরা রোজ সেহরিতে খাবার শেষে খেজুর খাই। গত রমজানের ২৪ বা ২৫ রোজায় শাহাদাত ভাইয়ের বাসায় রাতে সেহরির খাবার শেষ করে উঠবো এমন সময় ইউশা ফ্রিজ থেকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট এক পেয়ালা খেজুর বের করে সামনে দেয়। একটা খেজুর মুখে দিয়ে আরেকটা হাতে তুলে রাখি। ইউশা গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়। বেশ যত্ন করে ইউশা এবং তার অনুজ দুই ভাই আতিথিয়তা করে। সেহরি খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে জামাতে ফজরের নামায পড়বো বলে বের হয়ে আসি। এরপর ঈদুল ফিতর ফেরিয়ে এখন ঈদুল আযহার প্রস্তুুতি চারিদিকে। ঠিক এমন সময়ে ইউশার আকশ্মিক হারিয়ে যাওয়া সংবাদে আমরা স্তম্ভিত ও শোকাতুর হয়ে পড়ি। আত্মীয়, পরিচিতজন, সহপাঠী, শিক্ষক, অভিভাবক যারাই শুণছেন সবারই বাকরুদ্ধ জিজ্ঞাসু- এমন শান্তশ্লিষ্ট, কোমল, মৃদুভাষী ছেলেটির কি এমন অভিমান? কেন জীবনের আঙ্গিনায় এমন সরল পরাজয়? ইউশা আমরা কোন উত্তর খুঁজে পাইনা।

রমজানের শেষ দশকে দৈনিক ফেনীর সময় এর ঈদ বিশেষ আয়োজন ঈদ ম্যাগাজিনের সর্বশেষ কাজ নিয়ে টেবিলে টেবিলে ব্যস্ততা। সাহিত্য সম্পাদক বকুল আকতার দরিয়া পৌনে বারটায় চলে যান, তাঁর পরপরই বেরিয়ে যায় আরিফ আজম। অফিসে তখন সম্পাদক শাহাদাত ভাই, আলি হায়দার মানিক এবং আমি। শাহাদাত ভাই খুবই উদ্বিগ্ন ও অস্থির। আজ রাতের মধ্যে কম্পোজ ও মেকআপকৃত সকল লেখা, ডিজাইন না পাঠাতে পারলে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করা পুরোটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এর মধ্যে হঠাৎ করে দেখি একটি ফাইল পুরোই মিসিং হয়ে গেছে। ফাইলটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা। আমি আর কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকতেও পারছিলামনা। এক নাগাড়ে ৪/৫ ঘন্টা কম্পিউটারে কাজ করার ফলে মনিটরে তাকালে চোখে ঝাপসা দেখছি। মানিক ভাই অনেক খোঁজাখুঁজি করে বললেন ফাইল পাওয়া গেছে। যাক হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। টপাটপ এক-এক করে ফাইল গুলো প্রিন্টিং পাবলিশিং এ প্লেট মেক-আপের জন্য পাঠিয়ে দিলাম। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। অফিসে ডুকলো ইউশা। বড় একটা বোতলে করে ঠান্ডা শরবত, আর একটা টিফিন কেরিয়ারে করে পাটিসাপটা পিঠা, মাংসের কিমা রোল এবং তরমুজ। ইউশা এক-এক করে প্লেটে সাজিয়ে টেবিলে টেবিলে পৌঁছে দিতে দিতে তাগিদ দিচ্ছিলো, আঙ্কেল খেয়েনেন ঠান্ডা হয়ে যাবে। সেদিন আমরা প্রায় রাত পৌনে দুইটার সময় অফিস থেকে নেমে আসি। পুরো সময় তুমি আমাদের সাথে ছিলে। কেউ কারো সাথে খুব একটা কথা বলছিলামনা। কারণ সবার চোখে ঘুম। তোমার মধ্যে একটুও বিরক্তি ভাব দেখা যায়নি। আমাদের কম্পিউটারে হাতের কাজ যা ছিলো তার সবই প্রেস হাউজে পাঠিয়ে দিয়েছি। তবুও শাহাদাত ভাই’র অফিসে বসে থাকায় আমি বরং মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। সর্বশেষ প্রেস হাউজ থেকে ফোন এলো, সব কিছু ঠিকঠাক বুঝে পেয়েছি। এরপরই শহাদাত ভাই আমাদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। ইউশা আমাদের জন্য ডেকে রিকশা দরালো। একটা রিকশায় মানিক ভাই উঠে তার বাসার দিকে রওনা হলেন। আমি, ইউশা এবং শাহাদাত ভাই এক রিকশায় চেপে বাসায় ফিরলাম।

ঈদুল ফিতরের পর দুইবার দেখা হয়েছে ইউশার সাথে। দেখতেই ঠান্ডা মোলায়েম কন্ঠে সালাম দিতে দেরি করতোনা। দুইবারই শাহাদাত ভাই সাথে ছিলেন। বাবা ছেলের এতো নিবিড় যোগ সত্যি বিরল। ছায়া সঙ্গীর মত ইউশা তার বাবাকে যেন আগলে রাখতো। কখন ডাক্তার দেখাতে হবে, ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট। সময়মত ঔষধ সেবন। পিতার সবই সে দেখবাল করতো। এখন সেই পিতাকে শূণ্যতার সাগরে ছেড়ে তুমি পাড়ি জমালে পরপারে। এমন শূণ্যতাতো পূরণ হবার নয়রে বাপ। এমন প্রস্থান থেকে ফিরে আসা, ফিরে পাওয়া-ও তো সম্ভব নয়। দোয়াকরি, মহান মহামহিম দয়াময় আল্লাহ তোমার সকল উত্তম আচরণ, উত্তম কাজকে উচিলা করে ক্ষমা করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

গত দুইদিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউশার শোক বার্তা, দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনার করুণ আর্তি,স্মৃতি চারণ ইত্যাদিতে চেয়ে আছে ফেইসবুকের সচ্চ জমিন। সেখান থেকে দু’টি সম্যক স্মৃতিচারণ মূলক লেখা এখানে হুবহু তুলে ধরছি।

ফেনীর সিনিয়র সাংবাদিক আসাদুজ্জামান দারা ভাই লিখেছেন -ফলের প্যাকেট হাতে দিয়ে ইউশা বলল, এগুলো আম্মু আন্টির জন্য পাঠিয়েছে। আব্বুকে ব্যস্ততা কমিয়ে ফেলতে বলি কিন্তু উনি শুনতে চায়না।

গত বছর এইদিনে, বা জুন মাসের দিকে হবে- ইউশা এসেছিল আমাদের বাসায়। হাতে ছিল একটা ফলের প্যাকেট। তাতে ছিল বেশ কয়েক রকমের ফল। আমার হাতে প্যাকেট দিয়ে বলল, এটা আম্মু দিয়েছেন আন্টির জন্য। সীমা বাইরে থাকায় মেহমানদারি হয়নি। সেও বেশি সময় বসতে চায় নি। কয়েক মাস আগে ঢাকায় নিসচার (নিরাপদ সড়ক চাই) এক সমাবেশে আমরা ফেনী থেকে বাস নিয়ে যাই। শাহাদাত ভাই ও ইউশা আগে থেকেই ঢাকায় ছিলেন, তারা ফেনী আসবেন। সাথে ওর এক বন্ধুও ছিল। আমি বললাম, আমাদের বাসে জায়গা আছে। এখানে চলে আসেন। আরামবাগে এসে তারা বাস ধরলেন, আমাদের সাথে ফেনী এলেন। ওটাই ইউশার সাথে শেষ দেখা।

শাহাদাত ভাইয়ের পিতা ছিলেন আমার দেখা খুবই নরম মনের ভালো মানুষদের একজন। মা ও তেমনি। তারা নাতিদের প্রচন্ড ভালোবাসতেন, নাতিরাও দাদা-দাদির জন্য পাগল ছিল। শাহাদাত ভাই এবং খালাম্মা গতবছর যখন দুজনই হাসপাতালে, তখন টানা ডিউটি করেছিল ইউশা। সে যে কতটা দায়িত্বশীল ছিল তখন দেখেছি। ওইসময় প্রতি রাতে আমি ফোন দিতাম, খোঁজ খবর নিতাম। হাসপাতালে দায়িত্বরত ক্লান্ত ছেলেটা কখনো বিরক্ত হত না। অনেক্ষণ ধরে কথা হত আমাদের। আমি বলতাম, এবার তোমার বাবাকে বলবে ব্যস্ততা কমিয়ে বিশ্রাম নিতে। এতো কাজের চাপ বাড়িয়ে কি লাভ? সে বলত, আঙ্কেল আব্বুকে সবসময় বুঝাই, কিন্তু উনি শুনতে চায়না। সুস্থ হয়ে ফেরার পর কয়েকমাস ধরে বাবার সাথে সাথে থাকত সে। অনেক অনুষ্ঠানেও বসে থাকত পিতার দেখভালের জন্য। এমন দায়িত্বশীল ছেলেটা কেন এমন একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল, সে অঙ্ক কিছুতেই মিলাতে পারছি না। আমি প্রায়ই ভাবতাম, এই ছেলে পরিবার ও পত্রিকার দায়িত্ব নিতে পারবে একদিন। কিন্তু সে যে এতো জলদি নাই হয়ে যাবে কে জানত?

গত রাত পোনে দশটার দিকে মমারিজপুরের আনু মিয়াজী বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে যখন ইউশার দাফন হচ্ছিল, তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। মোনাজাতের সময় একটি টমটমের ভেতর বসে কোনমতে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করি। মোনাজাত শেষে দ্রুত ফেনীর দিকে পা বাড়াই। তখন রাত দশটা। শাহাদাত ভাইয়ের সাথে দেখা করিনি। কারণ, সদ্য সন্তানহারা পিতার চোখে তাকিয়ে কথা বলার মতো শক্তি আমার ছিলোনা।

সাংবাদিক ও পারিবারিক একান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আলী হায়দার মানিক লিখেছেন-

অনন্ত অসীম পথের পথিক ইউশা
বহুদূরে তুই অনেক ভালো থাকিস

আমার খালাম্মা ও খালুর অনেক আদরের বুকের ধন, বড় নাতি ছিলি ইউশা তুই। পরম আদর যত্নে তোকে আলোকিত মানুষ গড়ার চেষ্টা ছিল অব্যাহত। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তুই চলে গেলি মুক্ত আকাশের অধরায় আপন বিহঙ্গে। তোর খবর জানতে শুভাকাঙ্ক্ষীরা এ যাবত হাজার ছেয়ে গেছে। বাবা ছেলেকে আর কখনো দেখা যাবে না বৃরোপনে। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে।

যদি চলেই যাবি তাহলে এতো এতো বিনয়ী মনোভাব, নম্রতা, ভদ্রতা, নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী এবং মাধুর্য কেন দেখিয়েছিস? চাচা হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন কেন করেছিস? কখনো এক মুহুর্তের জন্যও বিন্দুমাত্র লাইনচ্যুত হওয়ায় দৃশ্য আমার অজানা।

তোর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তোর শিক্ষকদের কান্নার রোল থামানোর শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। ছাত্রের জন্য শিক্ষকদের কান্না আওয়াজ আমার কানে শত বছর বাজবে।
আমার বড় ভাই জনাব মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন তোকে আলোকিত সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সেই স্বাক্ষর তুই তোর কর্মে প্রামাণ করেছিস। তোর আব্বু আম্মুকে কি বুঝ দিবো আমরা সেই ভাষা অজানা।

বিগত বছরখানেক আগে তোর দাদু মণির চিকিৎসার জন্য ঢাকা ইবনে সিনা হাসপাতালে তোর যে দায়িত্বশীলতা দেখেছি তা ইতিহাসে বিরল। তখন তো দায়িত্বশীল আচরণে শুধু আমি না সবাই প্রশংসা নয় শুধু এটিতে পারিবারিক শিক্ষার অনুশীলন ঘটেছিল। সেটাতে তুই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিস। শুধুমাত্র সেটা নয় তুই জন্মের পর থেকে সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেলি। মেধা ও নৈতিকতায়ও চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিস।

একসঙ্গে তোর আব্বু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তখনও তুই সর্বোচ্চ ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছিস। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে দুইজন রোগীর সেবা করেছিস। অল্পসময়ের মাঝে যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছিস তা যুগ থেকে যুগান্তরে কাল থেকে কালান্তরে মানুষ স্মরণ রাখবে ইনশাআল্লাহ।
হে মহান আল্লাহ আপনি সর্বোচ্চ জিম্মাদার।

লিখন ও অনুলিখন : কিশান মোশাররফ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!