দিন-রাত, মাস ও বছর মহা প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তার অনুপম সৃষ্টি। সৃষ্টিগত ভাবে সবাই সমান। তবে মর্যাদাগত ভাবে সমান নয়। দিবসের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য শুক্রবার, ঊহুদীদের জন্য শনিবার এবং খ্রীষ্টানদের জন্য রবিবারকে সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাছাড়া আইয়্যামে তথা কুরবাণীর ঈদের পরে তিন দিন মর্যাদাপূর্ণ। মাসের মধ্যে রমযানকে ‘সাইয়্যেদুশ শুহুর’ বা সর্বোত্তম মান হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। তাছাড়া জাহেলী যুগ থেকে চারটি মাস সম্মানী ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আরব জাতি ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষের চরম মুহুর্তেও এ মাস চতুষ্টয়কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ মাস চতুষ্টয় হলো যিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। জিলহজ মাস মর্যাদাপূর্ণ চারটি মাসের মধ্যে অন্যতম। কারন, এ মাসের সাথে দ্বীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও ঘটনা জড়িত
প্রথম দশকের ফজিলত: ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হজ এ মাসের প্রথম দশকে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হযরত ইবরাহীম (আ) এর স্মৃতি বিজড়িত অসংখ্য ঘটনা এ দশকে ঘটেছে। হাজীগণ ৮ জিলহজ ইহরাম বেঁধে মিনার দিকে যাত্রা করেন এবং রাত্রে সেখানে অবস্থান করেন। আর যদি আরাফায় অবস্থান করেন। ৯ জিলহজ রাতে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে গমন করেন। ১০ জিলহজ বড় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করেন। মহানবী (স) বলেছেন, ৯ জিলহজ তথা আরাফার দিনের রোযা দু’বছরের নফল রোযার সমতুল্য, আর ১০ মহররমের রোযা এক বছরের নফল রোযার সমতুল্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ আর আমি মুসার সাথে ত্রিশ রজনির ওয়াদা করেছি এবং তা পূর্ণ করেছি আরো দশ দ্বারা (সূরা আরাফ-১৪২)। তাফসীরবিদগণ বলেন হযরত মুসা (আ) এর জন্য বর্ধিত দশ দিন ছিল জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দমকের নেক আমলের চেয়ে উত্তম আর কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা কি এই দশকের আমলের চেয়ে উত্তম নয়? রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এর চেয়ে উত্তম নয়; তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছে এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসতে পারেনি (আবু দাউদ: হাদিস নং-২৪৩৮, বুখারি: হাদিস নং-৯৬৯)। হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) বলেছেন, ‘দুনিয়ার দিবসসমূহের মধ্যে আমলের জন্য সর্বোত্তম দিস হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশক। প্রশ্ন করা হলো, আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম নয়। তবে হ্যাঁ, শুধু তার আমলই উত্তম, যে (জিহাদের ময়দানে) তার চেহারাকে ধূলামিশ্রিত করেছে (মুসনাদে বাজজার: হাদিস-১১২৮)। সাঈদ ইবন জুবাইর (র) জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন সমাগত হলে সৎকর্ম করার জন্য এতো বেশি পরিশ্রম করতেন যে, তাকে নিয়ন্ত্রন করা দুঃসাধ্য ছিল। হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন ইবাদত করা আল্লাহর কাছে এতো প্রিয় যে, অন্য কোন দিনের ইবাদত এত প্রিয় নয়। এর প্রত্যেক দিনের ইবাদত পুরো এক বছরের ইবাদত সমান এবং প্রত্যেক রাত্রের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমান (তিরমিযী, ইবন মাজাহ, বায়হাকি)।
প্রথম দশকে মুমিনের আমল: জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কুরবাণী করা পর্যন্ত কুরবাণী দাতার চুল, মোচ, নখ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা মুস্তাহাব। এ সর্ম্পকে হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহাজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির উচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কুরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস-৩৬৫৬)। এ আমল মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। ফিকাহবিদগণ বলেছেন কুরবানি করার আগে নখ, চুল, গোঁফ উত্যাদি না কাটার পেচনে হিকমত হচ্ছে হজযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য করা। কারন, তাদের ইহরাম অবস্থায় এ সব কাটা নিষিদ্ধ। ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেন, পশু কুরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিছু অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি (ত্যাগ) করার ব্যাপারে যেন সে অভ্যস্ত হয়, এজন্যই এ নির্দেশ।
তাকবিরে তাশরিক পড়া: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসর নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। এটি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সকল বালেগ, পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী বা একাকী আদায়কারী প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি.বাহরুর রায়েক)। এ তাকবির একবারের বেশি না বলা বাঞ্ছনীয়। কারণ একের অধিক বলার বিধান নেই। (তাহতাবি, পৃষ্ঠা নং- ২৯৪) তাকবিরে তাশরিক হলো- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।
পশু কুরবানি করা: এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানি করো।’ (সুরা: কাউসার, আয়াত: ২)
ইবন কাসির বলেছেন সূরা ফজরের এক ও দুই আয়াতে তথা শপথ প্রভাতের, শপথ দশ রাতের, যে দশ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা জিলহজের প্রথম দশক (ইবন কাসির চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৫৩৫)।
মুফতী মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রধান ফকীহ্
আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।