সতর্কতা-সাবধানতার পরামর্শের পরও খামখেয়ালি-হেয়ালি করাও আমাদের একটি রোগের মতো। তা পরিবেশ, পরিস্থিতি এমন কি মহামারি নিয়েও। অতিমারি করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সতর্ক বার্তাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো এক বছরেরও আগে জানানোর পরও গা না মাখার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। ছিল ডেমকেয়ার ভাব। মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত ভাইরাসকে বলা হয় ভ্যারিয়েন্ট। এর সতর্কতায় বলা হয়েছিল, বেশ কিছু সময় ধরেই বিশ্ব জুড়ে অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত করেছে। করোনাভাইরাসের অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের একটি উপ-ধরণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কারণ এটি ‘দ্রুত ব্যাপকভাবে বিস্তার’ লাভ করছে।
তারওপর সম্প্রতি জেএন.১ নামে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাওয়া গেছে। সংস্থাটি হুশিয়ার করে এও বলেছিল গেল শীতকালে কোভিড ও অন্যান্য সংক্রমণ বাড়তে পারে। এ সংক্রমণে ঠিকই সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে ফ্লু এবং মাঝারি ঠাণ্ডা এবং নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগ বাড়ছে। নতুন রূপে করোনার এ হানা রুখতে দেশের স্থল ও বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সকল জেলা হাসপাতালে শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা ও জরুরি সেবার জন্য হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কতায় ঘাটতি নেই। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারির পর এ বছরের মে মাসে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। ১ হাজার ৪০৯টি নমুনা পরীক্ষায় ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ কভিড পজিটিভ পাওয়া গেছে। নমুনা পরীক্ষায় প্রায় ১০ শতাংশের মাঝেই করোনা পজিটিভ ধরা পড়া যেনতেন বিষয় নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে শনাক্ত হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় ও জেলাপর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ফের চালু হচ্ছে করোনা নমুনা পরীক্ষা। প্রাথমিকভাবে যেসব মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে আরটিপিসিআর ল্যাব রয়েছে, সেসব হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ভারতে এনবি.১.৮.১ নামে আরেকটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জেনেটিক সিকুয়েন্স পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা গেছে। গত ২৩শে মে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বুলেটিনে বলা হয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এর সংক্রমণ হার তুলনামূলকভাবে বেশি। ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। তারপরে গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এই স্থানগুলোকে ‘সংক্রমণের হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শঙ্কা, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভারতের সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে। এজন্য বেনাপোলসহ সকল স্থল, নৌ ও বিমান বন্দরে স্ক্রিনিংসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন যাত্রীদের জিনগত পরীক্ষা এবং নজরদারি বাড়ানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। মে মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। আর জুন মাসের প্রথম আট দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন, এবং একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন অবস্থায় সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় সকলকে মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষত বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের এ ধরনের স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যে ব্যক্তি মারা গেছেন তিনি আরো নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আইসিডিডিআরবি এর তথ্যমতে, চলতি বছর সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো করোনার নতুন দুটো সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি এবং এক্সএফসি। যেগুলো ওমিক্রন জেএন.১ -এর একটি উপ-শাখা। সম্প্রতি যেসব নমুনা পাওয়া গিয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতে এক্সএফজি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। ফলে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে তারা বয়স্ক ব্যক্তি, শারীরিকভাবে দুর্বল কিংবা আগে থেকো জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা তাদের জন্য এই ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক হতে পারে। যে ভাইরাসের কারণে কোভিড হয় সেটি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং অনেক সময় এর কারণে নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হচ্ছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব জুড়ে অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জেএন.১ ভ্যারিয়েন্টসহ বর্তমানে অমিক্রনের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কাজ করছে।
করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাত নির্দেশনায় বলা হয়েছে- জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরিধান, হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা বা টিস্যু ব্যবহার, ব্যবহৃত টিস্যু ঢাকনাযুক্ত ময়লার ঝুড়িতে ফেলা, সাবান ও পানি অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে চোখ-নাক-মুখ স্পর্শ না করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা। এছাড়া, প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের স্থল ও নৌবন্দরগুলোর পাশাপাশি সবকটি বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা জোরদার করা হয়েছে। ভারত আক্রান্ত আরো আগে থেকেই। থাইল্যান্ড-চীনেও এর বিস্তার বেড়েছে। ভারতসহ যেসব দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়েছে, ওইসব দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে সংবাদবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে প্রয়োজন ছাড়া ওইসব দেশে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ধারণা করা হচ্ছে যে, এ ভ্যারিয়েন্টটি অন্যান্য ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সাথে সাথে সার্স-কভ-২ (করোনাভাইরাসের) এর সংক্রমণ বাড়াতে পারে। বিশেষ করে যে দেশগুলোতে শীতকাল শুরু হচ্ছে সেখানে এর সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। টিকা দেয়ার ফলে যে দেহে সুরক্ষা তৈরি হয়েছে সেটি ভাঙতে এই জেএন.১ ভ্যারিয়েন্ট কতটা সক্ষম, সে সম্পর্কিত তেমন কোন নথি-প্রমাণ নেই। মানুষ আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় এটি আরো বেশি অসুস্থ করে তোলে কিনা তারও কোন তথ্য নেই। ডাব্লিউএইচও বলছে, মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব কেমন হয় তা বুঝতে আরো বেশি গবেষণা করা দরকার। কারণ কোভিড আক্রান্ত হয়ে মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য দেয়ার হার বিভিন্ন দেশে নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।
করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস – যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। করোনাভাইরাসের পোশাকি নাম কোভিড-১৯, পৃথিবীতে এর বিস্তার শুরু ২০২০ সালের শুরুতে, জানুয়ারি ২০২১ নাগাদ বিশ্বের ১৯১ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী ৩০ লাখের মত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল আর ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল, সেটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস। চায়না ভাইরাস, করোনাভাইরাস, কোভিড ১৯, এনকভ ইত্যাদি নামে সে সর্বনাশ যা করার করেছে। এখন আবার নেমেছে। এর লক্ষণ আগের মতোই। রেসপিরেটরি বা শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ ছাড়াও জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। এই ভাইরাস ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। যদিও পরে ভাইরাসের ধরণে পরিবর্তনের সাথে সাথে উপসর্গ প্রকাশের সময়েও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকের উপসর্গ সাধারণ সর্দিজ্বর এবং ফ্লু’য়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক।
বর্তমানে এটি শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার ৪৮৬টি। এ পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্তের গড় হার ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ, সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
উল্লেখ্য, দেশে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় কেউ মারা যাননি।
এর আগে ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ওই বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
ঈদের ছুটির পরে ফিরতি যাত্রায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় সকলকে মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশেষত বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভিড়যুক্ত স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোভিডের যেকোন ভ্যারিয়েন্টই বয়স্ক, গর্ভবতী ও আগে থেকে জটিল রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই সতর্কতাই মূল দাওয়াই। করোনা বা কোনো মহামারি না থাকলেও নিয়মিত হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার, মাস্ক পরা, ও ভিড় এড়িয়ে চলার অভ্যাস থাকা উচিৎ। জরুরি দরকারে এখন আবার শুরু করতেই হবে। তা কোনো ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের বাতলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।