সোলায়মান ডালিম :
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে বহু সংগ্রামী কণ্ঠ উঠে এসেছে, যারা জনমানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নির্ভীকতার সাথে তাদের কণ্ঠস্বরকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনই একটি উদাহরণ ফেনী থেকে প্রকাশিত স্থানীয় দৈনিক ‘ফেনীর সময়’। শাসকের চোখে চোখ রেখে সত্য কথা বলা, ক্ষমতার মুখে গণমানুষের ভাষায় কথা বলা—এই কঠিন কাজটি ধারাবাহিকভাবে করে আসছে এ পত্রিকাটি, যা আজ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়, বরং ভাটির জনপদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এই দৈনিকটির নেপথ্যের নায়ক সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। তার নেতৃত্বেই ‘ফেনীর সময়’ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ধরে টিকে আছে সংবাদপত্র প্রকাশনার কঠিন বাস্তবতায়, যেখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, বিশেষ করে জেলা শহরে, একটি আপসহীন দৈনিক পত্রিকা টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন তা কেবল যারা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, তারাই জানেন।
শাহাদাত হোসেন নিজের জীবনকে বাজি রেখে, কখনো মানসিক নির্যাতন, কখনো আর্থিক চাপে, আবার কখনো মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করেও সংবাদপত্রটির প্রকাশনা চালিয়ে গেছেন। দুই ডজনের বেশি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে, শুধুমাত্র তিনি সত্য কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন বলে। অথচ, তিনি চাইলেই এই পথে না হাঁটতে পারতেন। কিন্তু জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর দায়বোধ, সমাজের জন্য কিছু করার আগ্রহই হয়তো তাকে এই কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে।
একটি সংবাদপত্র কেবল একজন সম্পাদক দিয়ে চলে না—এই পথচলায় তার পাশে ছিলেন আলী হায়দার মানিক, আরিফ আজম, শেখ কামাল, আমজাদ নাহিদ ও শাহেদ ভাইয়ের মতো নিবেদিত সহযোদ্ধারা। তাদের সবার একত্রিত প্রচেষ্টা ও দায়বদ্ধতাই ‘ফেনীর সময়’-কে রক্ষা করেছে, পত্রিকাটিকে করেছে পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা।
আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বলছে, এই পত্রিকার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আপোষহীনতা। রাজনৈতিক চাপ, আর্থিক সংকট, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে এটি। অনেকেই সংবাদপত্রকে ব্যবসা হিসেবে দেখে, আবার অনেকে ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ‘ফেনীর সময়’ তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছে। তারা সংবাদকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না করে বরং একে নিয়েছে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে।
দীর্ঘ ১৭ বছর একটি পত্রিকা টিকে থাকা কেবল সময়ের হিসাব নয়, এটি সাহস, আদর্শ এবং দায়িত্ববোধের এক অবিচল স্বাক্ষর। এই ১৭ বছরে ‘ফেনীর সময়’ যা করেছে, তা বহু জাতীয় দৈনিকের পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠেনি—একটি নির্দিষ্ট জনপদের দুঃখ-দুর্দশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শব্দে রূপ দিয়ে মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া।
এই সাহসী পথচলায় অবশ্যই অনেক ব্যর্থতা এসেছে, অনেকে হয়তো সমালোচনা করেছেন, ভুল ধরিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পত্রিকাটি তার মৌলিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়নি। সম্পাদক ও তার টিমের কাছে এই লড়াইটি ছিল আদর্শের। তাই বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা, ঠিক যেমন একটি নদী তার নিজস্ব গতিতে পথ খুঁজে নেয়, তেমনি ‘ফেনীর সময়’ও সংবাদপত্রের মরুভূমিতে বয়ে চলেছে এক সততার জলধারা।
আজ এই পত্রিকার ১৭ বছরের পূর্তি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের জন্মদিন নয়, এটি সততার, সাহসের, প্রতিরোধের এবং সবচেয়ে বড় কথা—জনগণের পাশে থাকার এক দীর্ঘ অধ্যায়ের উদযাপন।
এদেশের প্রতিটি জেলা শহরেই যদি এমন একটি পত্রিকা থাকতো, যেটি কারও চামচামিতে নয় বরং সত্য বলার দায়ে সাহসী হতো, তবে গণমাধ্যম অনেকটাই দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ এবং সমাজমুখী হতো।
এই দীর্ঘ পথচলায় ‘ফেনীর সময়’ এর সঙ্গে যুক্ত থাকা সকল সংবাদযোদ্ধাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন। তাদের এই লড়াই যেনো অব্যাহত থাকে আগামীর দিনগুলোতেও—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, জনগণের পাশে।
লেখক- রিপোর্টার, এখন টেলিভিশন।