নিজস্ব প্রতিনিধি :
সোনাগাজীতে এখন মাঠজুড়ে হলুদের ঢেউ। প্রাকৃতিক দূর্যোগ না থাকায় উপজেলার প্রায় শতাধিক এলাকায় সরিষার ভালো ফলন হয়েছে। এতে কৃষকের দুশ্চিন্তা দুর হয়ে বাম্পার ফলন হওয়ায় আনন্দিত প্রান্তিক সরিষা চাষিরা। এ বছর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার ৪৫৫ হেক্টরের বেশি প্রায় ১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে কমপেক্ষে ১ হাজার ৭০০ কেজি শর্ষে উৎপাদিত হয়। সেই হিসেবে এবার ১ হাজার ৯০৪ মেট্টিক টন শর্ষে উৎপাদিত হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ফসলের মাঠে ফোটা সরিষার ফুল সবার নজর কেড়েছে। মাঠজুড়ে সরিষার সমরাজ্যে হলুদ ফুলের ঘ্রাণ ও মধু খেতে মৌমাছিসহ বিভিন্ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গের আনাগোনার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সুমধুর সুরে মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সরিষার মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন প্রকৃতির ঢেলে দেওয়া চোখ ধাধানো হলুদের সমারোহ।
চাষিরা জানায়, এ উপজেলায় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস হচ্ছে সরিষা চাষের উপযুক্ত সময়। এছাড়া ফেব্রæয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চাষিরা সরিষার ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেন। এখন অনেক এলাকায় সরিষার খেত ফুলে ফুলে ও সরিষার দানায় ভরে রয়েছে। এবার সরিষা চাষে আশানুরুপ ফলন হওয়ায় কৃষকরা অনেক খুশি হয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় ১হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৮০টি জমিতে সরিষার প্রদর্শনী করা হয়েছে। দিনদিন উপজেলায় সরিষার আবাদ বেড়েই চলেছে। গত বছর উপজেলায় ৫৩৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর আগে ২০২০সালে উপজেলায় ৩৫৫ হেক্টর এবং ২০২১সালে ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৬৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫৫ হেক্টও বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। সরিষার খেতে ফুল ফোটায় ও দানা দেখা যাওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কর্মকর্তা ও কৃষকরা। তবে মাঠে সরিষার আবাদ দেড় হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলছে কৃষকরা।
সরেজমিনে উপজেলার কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষকের মাঠ সরিষা ফুলে ছেয়ে গেছে। সরিষার দানা দেখে মনে হচ্ছে ফলনও ভালো হয়েছে। মৌমাছির দল ফুলের মধু আহরণের জন্য আনাগোনা করছে। অনেককে সরিষার খেতে হলুদের সমরাজ্যে নিজেকে ক্যামেরা বন্দি করতে ছবি তুলতে দেখা গেছে।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সরিষার চাষ শুরু হয়। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনমাস পর কৃষকেরা ফলন ঘরে তোলে নিতে পারেন। ধান ও অন্যান ফসলের তুলনায় সরিষা লাভ জনক হওয়ায় কৃষকেরা দিন দিন সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তারা বলেন, উচু জমি সরিষা চাষের জন্য উপযুক্ত ও ভালো স্থান। প্রথমে জমিতে হালকা ভাবে চাষ দিয়ে সরিষার বীজ বপন করতে হয়। এরপর দু-একবার ওষুধ ও পোকা-মাকড় দমণকারী কীটনাশক দিলেই সহজে ফলন ভালো হয়। তুলনামূলক কম পরিশ্রমে অধিক লাভ হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকদের দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
চরদরবেশ ইউনিয়নের চর সাহাভিকারী এলাকার কৃষক মো: মাঈন উদ্দিন বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের সার বীজ ও পরামর্শসহ বিভিন্ন ধরণের সহায়তা নিয়ে ৪০ শতক জমিতে তিনি সরিষার আবাদ করেছেন। কৃষি অফিস তার জমিতে একটি প্রদর্শনীও করেছে। বছরের শুরুতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় পরিশ্রম এক বেশি করতে হয়েছে। তারপরও ফলন ভালো হওয়ায় তিনি ভালো লাভ করার আশা প্রকাশ করেন।
উপজেলা চর চান্দিয়া এলাকার কৃষক আবুল খায়ের বলেন, ধানের চেয়ে সরিষা চাষে পরিশ্রম ও খচর কম লাগে। কিন্তু ধানের চেয়ে সরিষায় লাভ বেশি। তিনি এবার ৫৫শতক জমিতে সরিষা চাষ করেছেন।
চরচান্দিয়া এলাকার কৃষক নুর নবী বলেন, তিনি প্রতি বছর ১০ শতক জমিতে সরিষার চাষ করেন। পরে উৎপাদিত সরিষা বিক্রি না করে পৌর শহরের সরিষা ভাঙার কল থেকে তেল করে তিনি নিজে ব্যবহার করেন। ১০ শতক জমির সরিষা দিয়ে তার প্রায় সাত-আট মাস চলে যায়।
উপজেলা সহকারি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র দাস বলেন, উপজেলায় বারি-১৪ জাতের সরিষার চাহিদা বেশি হওয়ায় কৃষকরাও বারি-১৪ চাষ করেন। মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিনমাসে সরিষা ঘরে তোলা যায়। এতে প্রতি হেক্টরে সরিষা উৎপাদন হয় সাড়ে ১৬০০ কেজির বেশি। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলেও উৎপাদন ১৮০০ কেজি ছাড়িয়ে যায়। উপজেলা উৎপাদিত সরিষা দিয়ে ভোক্তাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে উপজেলার বাজারগুলোতে প্রচুর পরিমাণ সরিষার তেলের চাহিদা রয়েছে। অনেক মানুষ এখন তরকারি ও সবজি রান্না করার সময় সয়াবিন তেল ছেড়ে সরিষা ব্যবহার করছেন।
তিনি বলেন, উপজেলায় অনেকে সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। এমন কৃষক নেই। তবে আগামীতে প্রশিক্ষণ দিয়ে সরিষা থেকে মধু সংগ্রহের বিষয়ে কৃষকের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পৌর শহরের খায়ের ষ্টোরের মালিক নুরুল আলম বলেন, তার দোকানে আগে সয়াবিনের প্রচুর চাহিদা ছিল। কিন্তু গত দুই-তিন বছর থেকে হঠাৎ করে সরিষার চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি মাসে প্রায় বিভিন্ন ধরনের ৮-১০ মণ সরিষার তেল বিক্রি করে থাকেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা আল আমিন শেখ বলেন, উপজেলায় ৩ হাজার ৭০০জন তালিকাভুক্ত কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারীভাবে সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ করে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সরিষা চাষে কৃষকদের নিবিড় পরিচর্যা ও আন্তরিকতার কারণে এবার সরিষার ফলন ভালো হওয়ায় বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এবার কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তায় অনেকগুলো অনাবাদি জমিকেও সরিষাসহ অন্যান ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার বলেন, গত দুইবছরের করোনার ধাক্কা সামালে এবার কৃষকরা অনেক কষ্ট করে সরিষার গাছগুলো বেড়ে তুলেছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সরিষার ফলন তারা ঘরে তুলতে শুরু করবেন।
তিনি বলেন, এবার সরিষার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬৬৫ হেক্টর। কিন্তু চাষাবাদ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুন ছাড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরও সরিষা চাষ বাড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।