ভালোবাসা কি এনিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোবাসা নিয়ে গানে গানে প্রশ্ন রেখে গেছেন- ‘ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে? তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা সখি ভালোবাসা কারে কয়? সেকি কেবলই যাতনাময়, সেকি কেবলই চোখে জল, সেকি কেবলই দুখের শ্বাস, লোকে তবে কি সুখের তরে করে এমন দুখের আশ।’ শেক্সপিয়ার তাঁর এক নাটকের সংলাপে প্রশ্ন রেখেছেন, হোয়াট ইজ ইউ লাভ ? ভালোবাসা নিয়ে যত দু:খ-কষ্ট, বেদনা- সংশয়, নেতিবাচকতা থাক না কেন, সবাই একটু ভালোবাসা হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ায়।
জগত ব্যাপী একটি সুমধুর বচন ভালোবাসা। এর উৎস স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্। তাঁর ভালোবাসার বহি:প্রকাশ তাঁরই সৃষ্ট জগতে প্রতিভাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রেমময় মহান আল্লাহর এক অসাধারণ স্বর্গীয় নেয়ামত হলো সৃষ্টির প্রতি তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনি তাঁর সৃষ্ট প্রাণীকুলের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধনের সৃষ্টি করেছেন তা-ই প্রেম ও ভালোবাসার রূপ পেয়েছে। এই প্রেম-ভালোবাসা আল্লাহ্ প্রদত্ত এমন এক পবিত্র আবেগানুভূতি যা হৃদয়ের গহীন থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়। ভালোবাসার আকর্ষণে বা বিকর্ষণে কখনও তা প্রকাশিত হয় মিলন মাধুর্যে, কখনওবা বিরহ-বেদনায়। পবিত্র হাদীসে বর্ণিত আছে,- ‘পরিপূর্ণ ভালোবাসার মাত্র এক শতাংশ তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিতরণ করেছেন, বাকী নিরানব্বই শতাংশই তাঁর নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন।’ আর এই এক শতাংশ ভালোবাসার দ্বারাই সমগ্র সৃষ্টি আপ্লুত হয়ে আছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের অপত্য ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার গন্ডী পেরিয়ে সমাজ-সংসার, পরিবেশ-প্রকৃতি সর্বত্রই ছড়িয়ে তা আছে। প্রেম-ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার পরশে মানবজীবনে স্বর্গীয় শান্তি নেমে আসে। ভালোবাসার বন্ধন একান্ত আপন জনকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন রূপ ধারণ করে। মানব প্রেম, স্বজাতি ও স্বদেশ প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, স্রষ্টার প্রতি প্রেম নিয়ে কবি-সাহিত্যিক কত যে প্রেমোপাখ্যান লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রেম-ভালোবাসায় কত লক্ষ-কোটি প্রাণ উৎসর্গকৃত হয়েছে- তা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়, কবির কাব্য-গাঁথায় আছে এসব কাহিনীর ভূরি ভূরি নজীর।
জীবজগতের মধ্যে পারস্পারিক আন্ত:ম্পর্ক হল ভালোবাসা। যার শক্তিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জয় করা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উচ্চরিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ভালোবাসা’। একে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ভাগ করা যায়। যেমন: ধর্মীয় ভালোবাসা, বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা প্রভৃতি। পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসা বিদ্যমান। ভালোবাসায় যৌনকামনা বা শারীরিক লিপ্সা একটা গৌণ বিষয়। এখানে মানবিক আবেগটাই বেশি গুরুত্ব বহন করে। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ প্রায় সময়ই অতি আনন্দদায়ক হতে পারে এমনকি কোন কাজ বা খাদ্যের প্রতিও। আর এই অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান, পরিবার, সমাজ এমনকি দেশের জন্যও ভালোবাসা।
ভালোবাসা শুধু প্রাপ্তি নয়, ভালোবাসা প্রকৃত যে বিষয় তা হলো ত্যাগ। একে অন্যের জন্য, বিশেষ বস্তু বা কাজের জন্য, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার। কিন্তু দু:খের সাথে বলতে হয় আমাদের প্রায় প্রতিটি কাজেই ত্যাগের মানসিকতার বড়ই অভাব। হীন ব্যক্তি স্বার্থ চরিত্রার্থ করতেই যেন আমাদের প্রতিযোগিতা। এই মাসটি ফেব্রæয়ারী মাস, আমাদের জাতীয় চেতনার মাস, ভাষার দাবি আদায়ের মাস। এ মাসেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনেকেই আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবেসে জীবন দিয়েছেন। এই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির ভালোবাসা ও ত্রিশ লাখ শহীদের ত্যাগের ফসল। কিন্তু আজ প্রায় প্রতিদিনই ভালোবাসাহীন, অমানবিক কাজের সংবাদ, সংবাদ পত্রে দেখতে পাই, যা আমাদের ব্যথিত করে। হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশুসহ মারা যাওয়া, কত জানা-অজানা অকালমুত্যু ঘটছে। আগুণ লেগে আর ভবন ধসে শ্রমিকের লাশের সারি, ফিটনেস বিহীন বাস-ট্রাক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু তো অবিরাম। তিন দশক আগে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দাবি জানিয়ে ছিলেন নিরাপদ সড়ক চাই। চার দশক আগে নির্মল সেনের ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। এত বছর পরও এ দাবি পুরন হয়নি। কিন্তু এটা তো একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিকের সামান্য দাবি।আমাদের নাগরিকদের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর বহু পথ চালু রেখেছেন এদেশের স্বার্থপর ক্ষমতাবানেরা, বিত্তশালীরা। এছাড়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে, ধর্ষণ-হত্যা,ঘুষ-দুর্নীতি বিরামহীন অনেক কিছু। তালাক যৌতুকের মতো সীমাহীন কর্মকান্ড। এমন কি বৃদ্ধ মা-বাবার স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে ! এতো সব স্বার্থপরতা, মানবিকতাহীন কর্মকান্ড ভালোবাসার অভাব ও অপব্যবহারের বহি:প্রকাশ।
পরিবার, রাষ্ট, সমাজ, সংগঠন সবগুলো প্রতিষ্ঠান ভালোবাসার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই সমাজ, রাষ্ট্র, সংগঠন, পরিবার যেকোন জায়গা থেকে ভালোবাসার দাবি পুরণে স্ব-স্ব দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশটা শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়া বা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিকবিদেরই নয়। দেশটা আমার আপনারও। এই দেশটাকে বা পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার, ভালোবাসায় পূর্ণ করে তোলা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ প্রকৃত ভালোবাসার বড়ই আকাল। ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে জনপ্রাণী ও প্রকৃতি বিভিন্নভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মানুষই এখন মানুষের বড় শত্রæ। পরিবেশ ও প্রকৃতিও মানুষের লোভ-লালসা ও স্বার্থপরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়ে মানুষ নিজেই এ সুন্দর পৃথিবীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোগ-বিলাস ও যৌনতার বাড়াবাড়ির ফলে মানুষ তার নিজের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যুদ্ধ-হানাহানি-সন্ত্রাস, ক্ষুধা-দারিদ্র, বৈষম্য-বঞ্চনা, শোষণ-নির্যাতন, রোগ-ব্যাধি, ইত্যাদি বিপর্যয়ে ভরে গেছে এ পৃথিবী। আণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমার মত পারমানবিক অস্ত্রের মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন মানব সভ্যতা।
মানুষের বিধ্বংসী সব কর্মকান্ডের ফলে ভালোবাসা ও শান্তি বিদূরিত হয়েছে পৃথিবী থেকে। মানুষকে তার নিজ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই সত্যিকার ভালোবাসায় অবগাহন করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থপরতার ঊর্ধে ওঠে সামষ্টিক ভালোবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। ব্যক্তিবাদী বা গোষ্ঠীবাদী ভোগসর্বস্ব চেতনার বদলে সার্বজনীন ভালোবাসা ও আত্মোৎসর্গের চেতনার উন্মেষ ঘটানোর সময় এখনই। গতকাল চলে গেল ১৪ই ফেব্রæয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হলো এ দিন। তরুণ-তরুণীর বেহায়াপনাসুলভ মেলামেশার মধ্যে এ দিবসটিকে সীমাবদ্ধ রেখে নয়, সার্বজনীন ভালোবাসার মানবিক আবেদন সৃষ্টির কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে এ দিবসটি উদযাপিত হোক এটা আমরা চাই। ভালোবাসা হউক প্রতিদিনের, প্রতিটা কাজেই থাকুক ভালোবাসার ছাপ। পৃথিবী থেকে সবাইকে একদিন বিদায় নিতে হবে, কিছুই নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই যাবার আগে কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের অনুপম সুন্দর গানের ভাষায় এ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক, স্বপ্ন হোক- ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গে’ এবার যাবার আগে। তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার করুণ হাসির অরুণ রাগে, অশ্রæ-জলের করুণ রাগে। রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে। যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে যাও।’
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।