fenirshomoy logo black

নাজমুল হক

রোযা মুসলমানদের ধর্মীয় বিধি বিধানের ৫টি মৌলিক বিধানের ৩য় গুরুত্বপূর্ণ খুটি বা স্তম্ভ। একজন মুসলমান কালেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ইসলামের ধর্মীয় ইবাদতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং রমজান মাসে ৩০টি রোজা রাখা। রোজা রাখা মানেই কমপক্ষে ১২-১৬ ঘন্টা পানাহার থেকে বিরত থাকা। নিজের জীবন ও জীবিকায় শুদ্ধি অভিযান চালানো। পরিবার ও সামাজিক বিভাজন দূর করা। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমানো। রোজা আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল নবী ও রাসূল এবং তাদের উম্মতের উপর ফরজ ছিল। রোজার পুরস্কার আল্লাহ তায়ালা নিজের হাতেই দিয়ে থাকেন। রোজায় ফটকাবাজ সিন্ডিকেট ব্যবসা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। মানুষের উপকার করা, যাকাত সাদকা দান অনুদান, খাদ্য ও পোশাক নিয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁডানো। রমজানের রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠি রোজা বা উপবাস পালন করে। মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘সিয়াম বা রোজা’। হিন্দু বা বৌদ্ধরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় উপবাস। খ্রিস্টানরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় ফাস্টিং’। রাজনৈতিক দলের বিপ্লবীরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় ‘অনশন’। মেডিক্যাল সাইন্সে উপবাস করলে তাকে বলা হয় অটোফেজি’। রোযার গুরুত্ব এবং স্বাস্থ্যের উপকারীতা গবেষণা করে জাপানের ওশিনরি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে। ২০১৬ সালে নোবেল কমিটি জাপানের ডাক্তার ওশিনরি ওসুমি ’কে রোযা ধর্মীয় গুরুত্ব এবং স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব আবিষ্কারের জন্যে পুরষ্কার প্রদান করে। এরপর থেকে বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে উপবাস পালন করতে শুরু করে।

অটোপেজি বা উপবাস একটি গ্রিক শব্দ এর শাব্দিক অর্থ হলো যথা অটো অর্থ নিজে, এবং পেইজি অর্থ খাওয়া। সুতরাং, অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। মেডিক্যাল সাইন্স ল্যাবের গবেষণায় দেখা যায় শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে তখন তাকেই অটোফেজি বলা হয়।

আরেকটু সহজভাবে বলি ? আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে, অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারাবছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে, ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে, কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়। শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতন অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মত অলস হয়ে বসে থাকে না , তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয়। কোষগুলোর আমাদের মতন আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। মেডিক্যাল সাইন্সে এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি।

শুধুমাত্র অটোফেজি বা উপবাস বা রোযা আবিষ্কার করেই জাপানের ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আবিষ্কার করেন ১২-২৪ ঘন্টা রোজা বা উপবাস থাকলে মানুষের দেহে অটোফেজি চালু হয়। তিনি প্রমান করেন যে, রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের নিম্নলিখিত দেহের উপকার হয়।

১। দেহের সেল পরিস্কার হয় ২। ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়। ৩। পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়। ৪। ব্রেইনের কার্যকরীতা বাড়ে। ৫। শরীর নিজে নিজেই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে ৬। ডায়াবেটিস ভালো হয়ে যায়। ৭। বার্ধক্য রোধ করা যায়। ৮। স্থূলতা দূর হয়। ৯। দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।

রোযার ধর্মীয় গুরুত্ব গবেষণা করে জাপানের ডাক্তার পেয়েছেন নোবেল পুরষ্কার তেমনি সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে পাকিস্থানের আমজাদ সাকিব। পাকিস্থানের আমজাদ সাকিব নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন তার সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ‘আখুয়াত’ এর জন্য। মডেলটি অনেকটা নোবেলবিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস এর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মত। তবে পার্থক্য হল এই মডেল সুদমুক্ত এবং জাকাতের সিস্টেম থেকে অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত।

ইসলামি শরীয়াহভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা ডা. আমজাদ সাকিব নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। পাকিস্থানের এ জনহিতৈষী দেশটির বৃহত্তম সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রোগ্রাম, আখুয়াতের প্রতিষ্ঠাতা। দারিদ্র্য বিমোচনে মানবিক কাজের জন্য তাকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পুরো বিশ্ব থেকে ২৫১ ব্যক্তি এবং ৯২ সংস্থাসহ মোট ৩৪৩ জন প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন।

ড. আমজাদ কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকের পর ১৯৮৫ সালে পাকিস্থান সিভিল সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সাত বছর পাঞ্জাব রুরাল সাপোর্ট প্রোগ্রাম, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগসহ বিভিন্ন উচ্চস্তরের সরকারি পদে কাজ করেছেন তিনি। সামাজিক সংহতি, সম্প্রদায় সংগঠন এবং দরিদ্রদের আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করাই ছিল এসব প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। একসময় তিনি উপলব্ধি করেন দরিদ্রদের চাহিদা পূরণের জন্য একটি বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োজন। তাই তিনি সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আখুয়াত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তার জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।

২০০৩ সালে সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন এবং একই বছর আখুওয়াত প্রতিষ্ঠা করেন ড. আমজাদ। প্রায় দুই দশক সফলতার সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করা আখুয়াত এখন শরীয়াহসম্মত ক্ষুদ্রঋণের একটি কার্যকর মডেল উপস্থাপন করেছে, যা খুবই টেকসই বলে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে আখুয়াত পাকিস্তানের বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানিটি এ পর্যন্ত ৯০ কোটি ডলারের সমতুল্য সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করেছে। ঋণ পরিশোধের হার প্রায় ১০০ শতাংশ। আখুয়াত ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যংকিং ও ফিন্যান্সের ক্ষেত্রে অনেক সামাজিক সংস্থাকে সেবা দিয়ে থাকেন ডা. আমজাদ। র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, কমনওয়েলথ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

মুসলমানদের নামাজ, যাকাত, ওশর ও হজ্জ উমরাহ নিয়ে গবেষণা করলে আরও নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সুযোগ আছে। নামাজ পড়তে হলে দৈনিক ৫ বার হাত, মুখ ও পা ধৌত করতে হয়। এভাবে ৫ বার অজু করার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে না। বিভিন্ন জিবানু থেকে অঙ্গসমূহ মুক্ত থাকে। জীবাণুর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। অজুর উপর গবেষণার জন্য কাজ করার সুযোগ আছে।

মুসলমানদের নামাজ আদায় করার ফলে শারীরিক মানসিক বিকাশ ঘটে। নামাজের পূর্বে অজু করে পবিত্র হতে হয়ে থাকে। ভালো পোশাক পরে স্রষ্টার সামনে একাগ্রতা নিয়ে ইবাদত করার ফলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। নামাজ আদায় করা এক ধরনের ব্যায়াম। নামাজ আদায় করে যারা তারা প্রতিদিন কমপক্ষে ১ ঘন্টা ব্যয়াম করে, এতে তাদের শারীরিক সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। হাড়গোড় মজবুত হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ফ্যাটের ক্ষয় হয়ে থাকে। পরিমিত আহার, ভালো নিদ্রা হয়ে থাকে ও মানষিক স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস পায়। যাকাত সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। দারিদ্র্য দূরীকরণ এ ভুমিকা রাখছে যাকাত। যাকাত ধনীদের সম্পদকে পবিত্র করতে সাহায্য করে। ওশর কৃষিকের ফসলকে পবিত্র করে।

মিথ্যা, গীবত, ঝগড়া, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা মানুষের হক নষ্ট করা, হারাম কাজ রোজাকে দুর্বল করে দেয়। গীবত পরনিন্দা অপবাদ মিথ্যাচার করে নিজেদের ব্যক্তিগত আমল আখলাক কেউই বাড়াতে পারবে না। যে লেখার মাধ্যমে গীবত ও গুনাহ হয়ে থাকে সেখান থেকে বিরত থাকা উত্তম কাজ। প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা দিবেন। সবাইকে একদিন আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে। যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ত্যাগ করতে পারে না তার রোজা উপবাস ছাড়া কিছু নহে। রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন রোজা গুনাহসমূহ ধ্বংস করে দেয়।

মুসলমানদের ইবাদত নিয়ে গবেষণা করা খুবই জরুরী। আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সাঃ মুসলমানদের ইবাদত করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। রোজা দান সাদাকাহ এর মাধ্যমে মানবতা জাগ্রত করে, সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য মানুষের অধিকার আদায়ের সুযোগ। মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগী নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। গবেষণা অব্যাহত থাকলে আরও নোবেল পুরষ্কার পাওয়া যাবে।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!