তাকওয়ার অনুশীলন একজন মুসলমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে তাকওয়া নেই তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। তাকওয়া একজন মানুষকে সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত ও আলোকিত মানুষে পরিণত করে। সত্যিকারের মানুষ হওয়ার জন্য তাকওয়ার অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই। পাপ ও কুলষমুক্ত পরিচ্ছন্ন জীবন শুধুমাত্র তাকওয়ার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। জাহেলী যুগের বর্বর, উশৃঙ্খল ও অসভ্য মানুষগুলোকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করতে, রাসূল (সা:) তাদের মনে তাকওয়ার বীজটিই বপন করেছিলেন। একটি অপরাধমুক্ত আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের জন্য তাকওয়াই একমাত্র কার্যকর মাধ্যম।
তাকওয়া কী? তাকওয়া অর্থ হচ্ছে বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা। ইসলামের পরিভাষায়, আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া। একবার হযরত উবাই ইবনে কাব (রা)-কে ওমর (রা) তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হে ওমর (রা)! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? তিনি বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে। হযরত উবাই ইবনে কাব (রা) বললেন, এটাই তাকাওয়া। তাকওয়াকে বুঝার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে কাদামাটিতে ডুবে থাকা বাইম মাছ। বাইম মাছ কাদা জলে ডুবে থাকে কিন্তু তার শরীরে এতটুকু কাদা লাগে না। সুতরাং আজকের এই পাপ পঙ্কিলতাপৃর্ণ পৃথিবী, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেখানে পাপাচার, অনাচার, শিরক, কুফর, বিদায়াত অক্টোপাসের মত ছড়িয়ে আছে, দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের কাঁটা যেখানে বিঁধে আছে, সেখান থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে সাবধানে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হবে। তাকওয়াই হচ্ছে যাবতীয় কল্যাণের মূল উৎস, জান্নাত লাভের অপরিহার্য শর্ত। কুরআনে যেখানে জান্নাতের আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে তাকওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা মরিয়ামে আল্লাহ বলেন, “সে জান্নাতের উত্তরাধিকারী আমি অবশ্য তাদেরকে বানাব, আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী।” (সূরা মরিয়াম ৬৩) তাকওয়াকারী ব্যক্তি এক দিকে নফসের যাবতীয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী ও অবাধ্য নফসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সমস্ত জুলুম-অনাচার, অত্যাচার ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে সংগ্রামী।
মানবজীবন অনেকগুলো দিকের সমাহারে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, অর্থ, রাজনীতি, বিচার, ব্যবসা প্রভৃতি অসংখ্য কর্মকান্ডের সমষ্টিই হচ্ছে মানব জীবনের স্বরূপ। সুতরাং মানব জীবনের ব্যাপ্তি কিন্তু সংক্ষিপ্ত নয়; বহুদূর। আর মানব জীবনের ব্যাপ্তি যতদূর, তাকওয়ার ব্যাপ্তিও ততদূর। ইসলামে শুধু ব্যক্তি জীবনে তাকওয়া অবলম্বন যথেষ্ট নয়। মানব জীবনের উপর্যুক্ত প্রতিটি দিকেই মানুষের তাকওয়া অবলম্বন ইসলামের অনিবার্য দাবী সেজন্য একজন মানুষ তার ব্যক্তিজীবনে যেমন তাকওয়ার অধিকারী হবেন, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, বিচারিক মোট কথা জীবনের সবক্ষেত্রেই হতে হবে তাকওয়ার অধিকারী। তাকে মসজিদে যেমন মুত্তাকী বা তাকওয়া অবলম্বনকারী হতে হবে, তেমনি তাকে ব্যবসায়ের গদি, চাকুরীর চেয়ার, রাষ্ট্রের সিংহাসনেও হতে হবে মুত্তাকী। বিশেষ ক্ষেত্রে মুত্তাকী হয়ে অপর ক্ষেত্রগুলোতে তাকওয়াবিহীন জীবন যাপন ইসলামে কাম্য নয়।
মানব জীবনের অন্যান্য দিকের চেয়ে তার অর্থনৈতিক দিকটি একটু ভিন্ন। কেননা অর্থনৈতিক জীবন লোভ লালসা ও আপোষহীন স্বার্থের সাথে জড়িত। সেজন্য অতি সহজে মানুষ এ জীবনে স্বার্থের কবলে পড়ে বিপদগামী হয়ে থাকে। তাই তার অর্থনৈতিক জীবন কালিমামুক্ত করে আলোকিত রাখতে হলে, তার তাকওয়া অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে এ ক্ষেত্রে বেশী বলিষ্ঠ ও বেশী শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক জীবনে যদি তাকওয়ার অনুশীলন করা না হয় তাহলে মানুষ হিংস্র পশুতে পরিণত হয়। পশুর মতই সে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ দর্শন শুরু করে। যেখানেই সে অর্থনৈতিক স্বার্থ টের পায়, সেখানেই সে হালাল হারামের পার্থক্য উপেক্ষা করে নিজের স্বার্থ উদ্ধাওে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। সে হারামকে আর হারাম মনে করে না। এর জন্য সে মানুষ হত্যা করতেও কুন্ঠিত হয় না। পক্ষান্তরে সে যদি অর্থনৈতিক জীবনে তাকওয়ার অনুশীলনে অভ্যন্ত থাকে, তাহলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহির শঙ্কায় শঙ্কিত হওয়ার কারণে হারাম পন্থায় স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা থেকে সে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। সুতরাং অর্থনৈতিক জীবনে পাপমুক্ত থাকতে হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাকওয়া অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, জীবনের অনেক ক্ষেত্রে তাকওয়া লালন করে মুত্তাকী হওয়াটা সহজ হলেও অর্তনৈতিক ক্ষেত্রে মুত্তাকী হওয়া বেশ কঠিন।
সমগ্র পৃথিবীতে যত বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধবিগ্রহ ও দাঙ্গা হাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয়েছে এর অধিকাংশের পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। তাকওয়ার অনুপস্থিতিই মূলত: এসব পাপাচারের জন্ম দিয়েছে। আমাদের সমাজের যে অর্থনৈতিক অপরাধ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে তা হচ্ছে এই তাকওয়ার সংকটের কারণে। সুদী কারবার, ওজনে কম দেওয়া, মজুদদারী, মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়, ফরমালিন বা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করে লাভবান হওয়া, পণ্যের দোষ গোপন, ঘুষ গ্রহণ, ঘুষদান, আত্মসাৎ, জুলুম, প্রতারণা, লটারী, ফটকাবাজারী, জাল-জোচ্চুরি, অবৈধ ক্রয় বিক্রয়, কালোবাজারী, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, জোর দখল, ধোঁকা, ডিউটি পালন না করে বেতন গ্রহণ ও যাকাত না দেয়ার মত জঘন্য অর্থনৈতিক অপরাধে সমাজ আকন্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার পেছনে তাকওয়ার অনুপস্থিতিই মূল কারণ।
মহান আল্লাহর ভয়ে সন্ত্রস্ত্র হয়ে তথা তাকওয়ার গুণ অর্জনকারী কখনো এ ধরনের অপরাধ করার দুঃসাহস দেখায় না। কারণ তারা জানে কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে যার দুটিই হবে অর্থনৈতিক। ইবনে মাসউদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্ন না করা পর্যন্ত তার রবের নিকট থেকে এক পাও অগ্রসর হতে দেয়া হবে না। প্রশ্নগুলো হল: তার জীবনের সময়গুলো কোন কাজে ব্যয় করেছে, যৌবনকাল কোন কাজে লিপ্ত রেখেছে, সে কিভাবে তার অর্থ উপার্জন করেছে, তার অর্জিত সম্পদ কিভাবে কোন পথে ব্যয় করেছে এবং সে যে সত্য জ্ঞান লাভ করেছিল, তার কতটা সে তার জীবনে কার্যকর রেখেছে। আসলে মূল অর্থনীতি আয় ও ব্যয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এই দুই বিষয়ে প্রশ্ন করা মানে তার জীবনের সার্বিক অর্থনৈতিক জীবনকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা।
আমরা চাই এমন একটি আলোকিত সমাজ, কুলুষমুক্ত জনপদ, প্রত্যেকে নিজস্ব অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদানকারী লোকালয়। যেখানে সবাই ইসলামী অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে। আর্থ সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন সমাজ হবে। এজন্য অর্থনৈতিক জীবনে তাকওয়া অবলম্বনকারী জনগোষ্ঠির কোন বিকল্প নেই। পবিত্র রমজান মাসে তাকওয়া অর্জনকারী এ দল আমরা তৈরি করতে পারি। কারণ এ মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেন- হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। সেজন্য আসুন এই পবিত্র রমজান মাসে আমরা অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া অবলম্বনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক জীবনেও তাকওয়া অবলম্বন করি। অন্যকেও তাকওয়া অবলম্বনের আহবান জানাই। সকলে মিলে অর্থনৈতিক জীবনে তাকওয়া অবলম্বনের পরিবেশ তৈরি করি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।