দৈনিক ফেনীর সময়

ক্ষমতার পালাবদল ও আহত গণতন্ত্র

ক্ষমতার পালাবদল ও  আহত গণতন্ত্র

নাজমুল হক :

পলাশী থেকে বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সুয পরাধীনতার ছোবলে বন্দী হয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, বিভিন্ন আন্দোলন ও হাজারো হিন্দু মুসলমান ও বৌদ্ধদের জীবনের ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পাকিস্তান রাস্ট্রে বাংগালী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য বাংগালী জাতিকে মায়ের ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে হয়েছে। সালাম রফিক জাব্বার ও শফিককে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে আসাদ শহীদ হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাভের বিগত ৫০ বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বদলে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৮২ সালে জেনারেল এইচ এম এরশাদের ক্ষমতা দখল একটি অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বাকশাল গঠন, সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্তা স্থাপন, রাস্ট্র ধর্ম ইসলাম ইত্যাদি সংযোজন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ না ভোট, জেনারেল এরশাদ সরকারের হ্যাঁ না ভোট। ১৯৭৩ সালে ক্ষমতায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নিরস্কুশ বিজয় অর্জন, ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নিরস্কুশ বিজয় অর্জন। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জাতীয় পাটির নিরস্কুশ বিজয় অর্জন। ১৯৮৮ সালে প্রধান বিরোধী দল বিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এরশাদের নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের বিদায় একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি। ১৯৭১-১৯৯০ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে এবং গণতন্ত্রকে বাঁচাতে তত্তাবধায়ক সরকারের আগমন এবং বিরোধী দলের ক্ষমতা যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে সরকার গঠন করে। সরকারী দলের জায়গা বিরোধী দলের আসনে, এভাবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে। তত্তাবধায়ক সরকার বিশ্ববাসীর কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের রোল মডেল হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ নেয়। রাস্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬, ২০১৪, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিরস্কুশ বিজয় অর্জন করে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯ সালের জাতিয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরাজয় ঘটে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র তত্তবধায়ক সরকার ছাড়া ভোট ও উন্নয়ন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে ঃ

১. বাকশাল গঠন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা মাত্র চার বছরের মাথায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। বাকশালের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাকশাল সরকার পদ্ধতি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি বিরাট আঘাত। ৪টি সংবাদপত্র রেখে সকল পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে গণতন্ত্রের জন্য বংগবন্ধু ১৪ বছর পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী ছিলেন, সেই বংগবন্ধু বাকশাল কর্মসূচির জন্য দেশে-বিদেশে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন গণতন্ত্রের জন্য কবর রচনা করেছিল।

২. জাতীর পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকান্ড : ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। একদল উচ্চ বিলাশী সেনাকর্মকর্তারা এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি অংশ এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। বংগবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দিল্লিতে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে।

৩. খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখল : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা দখল করে। আওয়ামী লীগের অনেক সাংসদ ও রাজনীতিবিদ মোস্তাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদে জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও বিচার বন্ধের জন্য ইন্ডিমিনিটি অধ্যাদেশ পাশ করে।

৪. ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ জেল হত্যাকান্ড : শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয় তার ফলশ্রুতিতে ৩রা নভেম্বর সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ পাল্টা অভ্যুত্থান করে। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সে পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও সব কিছুর কলকাঠি নাড়ছিল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা। তখন সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড কার্যত ভেঙ্গে পড়েছিল। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আসে ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং বন্দী করা হয় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যখন সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হচ্ছিল তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের সিনিয়র ৪ জাতীয় নেতাকে কারাগারের ভেতরেই হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদ মোশাররফসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনাবাহিনী কর্মকর্তা। পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান এবং সিপাহি বিদ্রোহের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন বিপ্লবী ও সাহসী বীর সৈনিকরা। ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।

৫. জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ : ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অফিসাররা। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ৫ই নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এরপর ৬ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। কিন্তু ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। এসময় জিয়াউর রহমান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন।

কিন্তু এক বছর পরে ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এর পাঁচ মাস পরেই ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠন করেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের জন্য এক বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির পালাবদল ঘটে। জিয়াউর রহমানের গঠিত রাজনৈতিক দল নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রতি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে মধ্য-ডানপন্থী রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ সংযোজন করা হয়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিভিন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে অধিকার প্রদান করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি করেন।

কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনা প্রবাহ ঘটে। প্রতিটি অভ্যুত্থান জিয়াউর রহমান দমন করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন।

৬. জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল : জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনীতিতে আসার বাসনা প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে দিয়ে রাস্ট্র ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। রাজনীতির ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ অনেকটাই জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। জিয়াউর রহমানের মতো জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল মধ্য-ডানপন্থী। তিনি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করেন। জেনারেল জিয়া যেভাবে বিএনপি গঠন করেছিলেন, ঠিক তেমনি জেনারেল এরশাদও জাতীয় পার্টি গঠন করেন। জেনারেল এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশে ৯ বছরের সামরিক শাসক। জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ান।

১৯৯১ সালে ততত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ এই নির্বাচনকে মনে করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন’, যদিও এই নির্বাচনে পরাজিত দল আওয়ামী লীগ ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তুলেছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশে আরো চারটি সংসদীয় নির্বাচন হলেও সেসব নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ছিল। এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

এর আগের নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবু্দ্িদন আহমেদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্র্বতী সরকারের অধীনে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সরকারের সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি।

৭. খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী : জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া উনিশ’শ একানব্বই সালের ২০শে মার্চ বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হলেন মিসেস জিয়া।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, তখনকার সময়ে বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছিল।

৮. সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা : ১৯৯১ সালের ৬ অগাস্ট বাংলাদেশ সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুন:প্রবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ সংবিধানে যতগুলো সংশোধনী হয়েছে তার মধ্যে দ্বাদশ সংশোধনী হচ্ছে একমাত্র সংশোধনী যেখানে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে করা হয় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী হন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদকে জাতীয় সংসদের নিকট দায়বদ্ধ করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়।

৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ : বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার মাঝামাঝি সময়ে মাগুরার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একই সাথে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটি সহিংসতায় রূপ নেয়। এক পর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। রাস্তায় যখন সহিংস আন্দোলন চলছে তখন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায় বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সে নির্বাচন বর্জন করলে অনেকটা ভোটার-বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটার বিহীন সে নির্বাচনে জয়লাভের পর আবারো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। সে সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে সংবিধানে সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১০. একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় : সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্ত হবার পরে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে নানা চড়াই উতরাই পার করেছে দলটি। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করেছিল। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ভেবেছিল, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান নেই। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে ১৯৯৬ সালে আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।

১১. ২০০৭ সালে কুখ্যাত এক এগারো : ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, বিএনপি নিজেদের পছন্দমতো প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে নিশ্চিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সংকটের মুখে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা করে। রাজনৈতিক সংকটে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হয়। আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিসহ তাদের রাজনৈতিক জোট নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিরোধী দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া একক সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল বিএনপি।

সংঘাতময় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। রাজনীতিতে সেনা বাহিনীর এই হস্তক্ষেপ কুখ্যাত ঘটনা ‘১-১১’ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেনাবাহিনীর সমর্থনে ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেনা প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ছিলেন মূল ক্ষমতাধারী।

১২. যুদ্ধাপরাধীর বিচার : ড. ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতা দখল করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচার করার উদ্যোগ নেয়। সে জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।

এই বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাস্তায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং সরকার বেশ কঠোরভাবে সেটি মোকাবেলা করেছে। জামায়াতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা এই বিচারের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারী আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জমানসহ শীর্ষ নেতাদের এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

১৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল : ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর আগে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সর্ম্পকিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। তবে একই সাথে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপের পর বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এর পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের আর কোন সুযোগ রইল না এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেবার পর বাংলাদেশে আরো দুটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে দেশে-বিদেশে।

১৪. ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বিরোধী দল বিহীন সংসদ নির্বাচন : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করলেও তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের মধ্যস্থতায় সমঝোতার চেষ্টাও বিফলে গেছে। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি একতরফা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের নাগরিকদের নিকট গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটের লড়াইয়ে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করা যেন চিড়িয়াখানার বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে। বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভোটারদের নিকট ধারে ধারে ঘুরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে দেশের জন্য স্বাধীনতা এনে ছিলেন। ১৪ বছর কারাগারে বন্দী ছিলেন। সামরিক শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদ সরকারের বিদায় নিয়েছে। নতুন প্রজন্ম ভোটের লড়াইয়ে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে পারছে না। ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়েছে কিন্তু ইভিএম মেশিন নিয়ন্ত্রন করে পেশাদার রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তারা হাসিমুখে বলে আমাদের সামনে ভোট দিতে হবে অমুক লাঠিয়ালকে।

অনেক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে পুলিং ও প্রিসাইডিং অফিসার থেকে ব্যালট পেপার চিনিয়ে নিলেও প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করে। আজিজ সাহেব তাড়িয়ে নাগরিকদের ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে কি? ভোট ডাকাতি রোধ করতে রাজনৈতিক দলের লিডারদের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ১২০ জন ভোটার নিহত! ভোটচোর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বার পদে নিযুক্ত হয়ে বিধবার রিলিফচুরি করলে দোষ আছে কি? ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিকট নাগরিকদের প্রত্যাশা নির্বাচনের আগে নিজেকে সৎ ও যোগ্য, গরীবের বন্ধু, সমাজসেবক হিসেবে মাদকমুক্ত, দুনীতিমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত ইউনিয়ন গড়বেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

১) আপনার প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। ২) ইউনিয়নের উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডারবাজি থেকে দূরে থাকবেন! ৩) গ্রাম্য শালিস ও বিচারে বিচারের নামে চাঁদাবাজি থেকে দূরে থাকবেন ৪) যুবকদের মাদকবাণিজ্য ও মাদক সেবন থেকে দূরে রাখবেন!! ৫) অনেক ইউনিয়নে রাতেরবেলা গরু চুরি, পুকুরের মাছ চুরি এবং জমির মাটি চুরির মহড়া চলে সেদিকে কঠোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। ৬) নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধষনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবেন ৭) বিধবা ভাতা, বৃদ্ধ ভাতা, প্রেগন্যান্ট মহিলা ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে টাকা খাওয়া বানিজ্য থেকে দূরে থাকবেন। ৮) নির্বাচনের আগে যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পুরন করবেন। ৯) জেলা পরিষদের সামাজিক প্রকল্প সমুহ প্রতিটি গ্রামে দৃশ্যমান করবেন। ১০) টাকার বিনিময়ে নাগরিক সনদ, ওয়ারশ সনদ, জন্ম নিবন্ধন বানিজ্য রোধ করবেন। ১১) রাত্রের বেলা নিজের গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে ভোটারদের সুখে শান্তিতে বসবাস করার নিশ্চয়তা প্রদান করবেন!! বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা মোতাবেক গণতন্ত্র একদিন প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করবে।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!