অর্থমন্ত্রী একাদশ জাতীয় সংসদের ২৩তম অধিবেশনে দেশের ৫২তম বাজেট পেশ করেছেন। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ তম এবং বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের ১৫ তম বাজেট। নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপিত হলো। ফলে বাংলাদেশের শত কোটি টাকার বাজেট দিনে দিনে লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে এসে ঠেকেছে। রিজার্ভ-ডলারের সংকট, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী চাপসহ অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে এবার এই বিশাল বাজেট। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি।
নির্বাচন সামনে রেখে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ বাজেটের মধ্য দিয়ে সরকার তার সক্ষমতার জানান দিয়েছে। প্রতিটি বাজেটে সরকার তার সাধের কথা জানায়। কিন্তু, সামর্থের ব্যাপারটা উহ্যই থেকে যায়। এবারও নানা সাধ-টার্গেট। সাধ্য-সামর্থের কথা আড়ালে রেখে ধারকর্জে ভর করেই ৭ লাখ যেখানে সরকারের জোগান দেয়ার লক্ষ্য ৫ লাখ কোটি টাকা। সেটাও জনগণের কাছ থেকে পাওয়া করের টাকা। বাকি ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হবে।
সামনে নির্বাচন। বাজেটের টার্গেট পূরণের আশায় দাতা সংস্থা, ব্যাংক আর সঞ্চয়পত্র থেকে সুদে টাকা নেবে সরকার। যার সিংহভাগই সামাজিক নিরাপত্তা ও সার, ডিজেল, বিদ্যুতের ভর্তুকিতে খরচ করবে সরকার। টাকা জোগাড়ের খাত হচ্ছে কর। আর কর আদায়ের মাধ্যম হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং এনবিআরের সক্ষমতা শুধু সরকার নয়, সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানে।
বাস্তবতা জানাবোঝার পরও প্রতিবছরই তাদের ওপর রাজস্ব আয় ও আদায়ের একটা বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। তারা নানান জায়গায় করের জন্য হানা দেয়। এতে করে বিপত্তি আরো বাড়ে। পরে টেনেটুনেও ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে আর অর্থের অভাবে উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাঁটে শেষ করতে হয় অর্থবছর। এবারও তাই। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির অংক প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটি এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ঢাকতে বা আড়াল করতে যতো দোষ চাপিয়ে দেয়া হবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। এভাবে আর কতো? বিশাল বাজেট দিয়ে বেটাগীরি দেখাতেই হবে? বাস্তবতা প্রকাশ করা কি লজ্জার?
ধার করে ঘি খাওয়া বা আশপাশের লোকজনের কাছে নিজের তেলতেলে জৌলুস না দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পথপরিক্রমা তৈরিতে সময় লাগলেও তা ঠুনকা বেটাগীরি দেখানোর চেয়ে ভালো। বাজেটের বিশাল সাইজ দেখিয়ে মানুষকে সাময়িক খুশি করা, দেশের অবস্থা ভালো বলে জানান দেয়ার মাঝে বীরত্ব নেই। এরপরও নির্বাচনের বছর বিধায় সরকার এ পথটি বেছে নিয়েছে। পদ্মা রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প দেখিয়ে তাক লাগাবে। নির্বাচন সামনে রেখে এর বাইরেও হাজারখানেক নতুন-পুরোনো প্রকল্পের কাজ দেখিয়ে যেগুলোর কাজ চালিয়ে মানুষের চোখে ধাধা লাগাবে।
এ ধাঁধায় মানুষ শেষতক বুদ হয়ে থাকে না। রহস্য জেনে যায়। চলতি অর্থবছরে ঠিকমতো রাজস্ব আয় না হওয়ায় সরকার যে ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা ধার নিয়েছে, তা গোপন থাকেনি। নতুন অর্থবছরেও সরকার এ ধারদেনার বাইরে যেতে পারবে না। তা আরো বেশি করতেও পারে। বেসরকারি খাতের কী অবস্থা হবে তখন? তারা ঋণ খুঁজবে কোথায়? তাদের বিনিয়োগের কী দশা হবে? অনিবার্যভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। সরকারকেও ঋণের সুদ টানতে হবে। বিদেশি ঋণের দায় শোধেও বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ হবে। গোটা পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াবে তখন? আদৌ সম্ভব হবে ‘২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’?
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের এটা পঞ্চম বাজেট। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ, রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা, রিজার্ভ ও ডলার সংকটের মতো কঠিন বাস্তবতার মাঝে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে।
ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগে ইতিবাচক পরিবর্তন, কৃষিখাতে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়নে সমন্বিত কার্যক্রম এবং সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এডিবির আকার ও বাস্তবায়ন বৃদ্ধির আশা করছে সরকার। বিষয়টি কি এতো সহজ? সরকার সামনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আশা করছে কোন ভরসায়? জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যেই আগামী অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি-জিডিপির হার ৭ দশমিক ৫ অর্জনের প্রত্যাশা বাস্তবতার সঙ্গে কদ্দূর যায়?
এছাড়া মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও অনেক। মূল্যস্ফীতির সীমাহীন চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বাদে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেলের যে দাম, তার তুলনায় দেশের বাজারমূল্য অনেক বেশি। গত (নভেম্বর ২০২২-এপ্রিল ২০২৩) ৬ মাসের সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ দাঁড়িয়েছে, তখন আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর এই মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মাঝে আবার ভর্তুকির রেকর্ড তৈরি হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে সরকার ব্যয় করবে মোট ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ভর্তুকির বড় অংশ (৩৫ হাজার কোটি) টাকা ব্যয় হবে বিদ্যুতে। কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি। রপ্তানি ভর্তুকিতে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, প্রণোদনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়াও অন্যান্য খাতের ভর্তুকি যাবে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের শর্ত এবারের বাজেটে বড় চাপ। বর্তমান সরকার ঋণ পরিশোধের সামর্থ থাকলেই কেউ ঋণ দেয় ও নেয়; এ ধরনের গর্বের জানান দিয়েছিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার সময়। ঋণ দেওয়ার প্রথম বছরেই বাস্তবায়ন করতে হবে তাদের দেয়া শর্তগুলো। আইএমএফএর হিসাবে আগামী অর্থবছরে কর রাজস্ব বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। শর্ত অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা কম ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। নির্বাচনী বছরে সর্বোচ্চ ১৪ মেগা প্রকল্পে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমন ১৪টি মেগা প্রকল্প ও কর্মসূচির জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৫৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। বাড়ছে প্রায় ১১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এসবের গোটা দায় ও চাপ পোহাতে হবে সাধারণ মানুষদের।
রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ, রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা, রিজার্ভ ও ডলার সংকটের মতো বিষয়গুলোর কারণে বাজেটে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানোকেই হাতিয়ার করতে হয়েছে সরকারকে। ভ্যাটের হার এবং আওতাও বাড়াতে হয়েছে। যা মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ঠ মানুষকে আরো চাপের সাথে তাপেও ফেলবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক আয় ও দেশীয় আয়ে ঘাটতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা ভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে সামনে কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে –এ টেনশনের মাঝেই শত ছাড়িয়ে লাখ কোটি টাকার বাজেট পেল বাংলাদেশ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার যে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করেছে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এডিপিতে। সেই সঙ্গে আজাবের মতো ভর করেছে ডলার সংকটের তীব্রতা। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
নির্বাচনের বছর বিবেচনায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বড় প্রকল্পগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে বড় ১০ প্রকল্পেই মোট এডিপির ২৩ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যার পরিমাণ ৬০ হাজার ৫১ কোটি টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট (পিএফডি), এমআরটি-১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, এমআরটি-৬ প্রকল্প থাকছে সর্বাধিক বরাদ্দ পাওয়া শীর্ষ ১০ প্রকল্পের তালিকায়।
নির্বাচনী বছরে দেশীয় চ্যালেঞ্জের সাথে বৈশ্ব কিছু বিষয়ও রয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নের পথে বাধাগুলো এবার আরো ব্যাপক। বাস্তবায়ন হতে না দেওয়ার চক্র্ও রয়েছে। নিজেদের স্বার্থে এরা বাস্তবায়নের গতি বাড়ায়-কমায়। বাজেট বাস্তবায়নের যে গতি চলতি অর্থবছরে দেখা গেছে তা সামনেও অব্যাহত থাকলে নির্দিধায় বলা যায়, টানা ১৫ বছরের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি সামনে অপেক্ষা করছে। বাজেট ‘অর্থতৈকি’ বিষয় হলেও তা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’। যে রাজনীতির পরতে পরতে স্বার্থচিন্তা। নির্বাচনের বছরে এসে এবার তা আরো বেড়ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।