কামরুজ্জামান পলাশ :
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাম্যবাদী কবিতায় বলেছেন,
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী সকল কর্মপ্রতিষ্ঠানে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহন বেড়েছে বলা যায়। আমাদের দেশেও উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে কর্মসংস্থান সন্ধানে পুরুষের পাশাপাশি নারীর আগ্রহও বেশ চোখে পড়ার মতোন। তাছাড়া আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারীর সরাসরি অবদান লক্ষণীয়।
কিন্তু চিন্তা বিষয় হলো মহিলারা তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু প্রতিকূল পরিবেশ(চ্যালেঞ্জ) মোকাবিলা করে থাকেন।তার মধ্যে অন্যতম হলো নারীর প্রতি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি। গত ২১ মার্চ,২০২৩ খ্রিঃ বাংলাদেশের একটি অনলাইন ভিত্তিক জাতীয় নিউজ পোর্টাল এ “গার্মেন্টসের ৮০% নারীকর্মী মৌখিক ও শারীরিক যৌন হয়রানির শিকার“ শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়। এতে করে বোঝা যায় যে নারীর প্রতি কর্মক্ষেত্রে কি পরিমান সহিংস আচরণ করা হচ্ছে। এতে করে নারীরা কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে আমাদের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
১.যৌন হয়রানির সংজ্ঞা
জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক ২০০৮ সালে বৈষম্য,যৌন হয়রানিসহুন্যান্য হয়রানি এবং ক্ষমতারত অপব্যাবহার নামক বুলেটিনে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়।যাতে হলা হয়, যৌন হয়রানি হলো যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরন,যৌনতার সুযোগের অনুরোধ, অথবা যৌন আবেদনমূলক মৌখিক বা শারীরিক আচরণ, অথবা যৌন-প্রকৃতির অন্য কোনো প্রকারের আচরণ বা যুক্তিসঙ্গতভাবে অন্য কোনো ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, অপমান বা হয়রানিরূপে গন্য হয়।
২. প্রণয়নকৃত আইন
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি রোধে ভারত সরকার ২০১৩ সালে Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013 প্রণয়ন করেন।আইনটি প্রণয়নের মাধ্যমে ভারত সরকার কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নারীর স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করেন।
উক্ত আইন ৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে লোকসভা(সংসদের নিম্ন কক্ষ) দ্বারা অনুমোদিত হয়।রাজ্যসভা (সংসদের উচ্চ কক্ষ) দ্বারা ২৬ ফেব্রুয়ারী,২০১৩ সালে অনুমোদিত হয়। বিলটি ২৩ এপ্রিল,২০১৩ সালে প্রেসিডেন্টের সম্মতি পেয়ে আইনে রূপান্তরিত হয়। আইনটি ৯ ডিসেম্বর,২০১৩ সাল থেকে কার্যকর হয়।
ভারত সরকার উক্ত আইন মোতাবেক সকল প্রতিষ্ঠানের মালিককে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। উক্ত আইন অমান্যকারী প্রতিষ্ঠান মালিকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।
৩. আইন প্রণয়নের পটভূমি
Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013 উক্ত আইনটির ধারনা ভিসাকা গাইডলাইন্স বা ভিসাকা মামলা থেকে উদ্ভব হয়েছে। ভিসাকা গাইডলাইন্স বা ভিসাকা মামলার বিষয়গুলো কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অনুসরন করতে বলা হয়েছে। উক্ত ভিসাকা গাইডলাইন্স গুলো বিখ্যাত মামলা Vishakha and others v State of Rajasthan (1997) এর মাধ্যমে উদ্ভব হয়েছে।
Vishakha and others v State of Rajasthan (1997) মামলাটি একটি কতিপয় নারী সংগঠন কর্তৃক ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রাজস্থান সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে Public Interest Litigation (PIL) আকারে উপস্থাপিত হয়। যেখানে আবেদনকারীগন ভারতের সংবিধান কর্তৃক কর্মজীবী নারীদের যেসকল অদিকার প্রদান করা হয়েছে সেই সকল অধিকার সমূহ নিশ্চিত করতে বলেন।
৪. Vishakha and others v State of Rajasthan (1997) মামলার উদ্ভব
১৯৯৭ সালের আগে ভারতে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক নিয়মকানুন ছিল না। যেকোন প্রকার যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা নিয়োগকর্তা কর্তৃক সেটি মিমাংসা করা হতো। কোন নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হলে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড এর ধারা ৩৫৪ ও ধারা ৫০৯ অনুযায়ী অভিযোগ করা হতো।
১৯৯০ দশকে রাজস্থান রাজ্য সরকারের একজন কর্মী “বানওয়ারী দেবী“ যে কিনা শিশু বিবাহ বা বাল্য বিবাহ নিরোধে কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু বানওয়ারী দেবীর কাজে অনেকেই ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষন করা হয়। বানওয়ারী দেবী রাজস্থান হাইকোর্ট থেকে ন্যায় বিচার পাননি, কেননা কোর্ট অভিযুক্তদের মুক্ত করে দেয়। বিভিন্ন নারী গোষ্ঠী ও এনজিও গুলো একত্রিত হয়ে ভিকটিমের পক্ষে ন্যায় বিচার নিশ্চিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন দাখিল করে। যা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বেশ নজর কাঁড়তে সক্ষম হয়েছিল।
৪.১ Vishakha and others v State of Rajasthan (1997) মামলার ফলাফল
সবশেষ ১৯৯৭ সালে আলোচিত Vishakha and others v State of Rajasthan (1997) মামলার যুগান্তকারী রায় প্রকাশ করা হয়। উক্ত রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার নারী কর্তৃক অভিযোগ কিভাবে পরিচালনা বা মিমাংসা করা হবে সেই নির্দেশনা প্রদান করেন। বিজ্ঞ আদালত আরো বলেন, উক্ত মামলার নির্দেশনা সমূহ বলবৎ থাকবে যতক্ষন না উক্ত সমস্যা সমাধানকল্পে পরবর্তী কোন প্রকার আইন প্রণয়ন না হয়।
৫.আইনের ত্রুটি ও পরবর্তীতে সংশোধন
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যসভার একজন সদস্য ব্রিন্দা করত বিলটি উপস্থাপনের সময় অভিযোগ তুলেন যে, আইনের ভাষাগত সমস্যার কারনে উক্ত আইনের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত নারীরা ও কৃষিকাজের সাথে জড়িত নারীরা কোন প্রকার প্রতিকার পাবে না।
যাইহোক চূড়ান্ত বিল উপস্থাপনের সময় ধারা-৩ উপধারা-১ সংযোজন করে বিলটির ভাষাগত সমস্যার সমাধান করা হয়। এতে বলা হয়, “No woman shall be subjected to sexual harassment at any workplace” অর্থাৎ সকল প্রকার সকল শ্রেণীর নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৬.মন্তব্য
উন্নত দেশ কিংবা উন্নয়নশীল দেশ সমূহ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ীয়ে চলেছে। তাছাড়া তারা সমানভাবে কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীরে অংশগ্রহন অনেক প্রাধান্য দিচ্ছে। এতে করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে সমান সমান নারীরাও অবদান রাখছে। এভাবে একসাথে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে।পাশাপাশি নারীরাও স্বাবলম্বী হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে মিল রেখে ও কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহন বাড়াতে আমাদেরও উচিত যথাযথ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা ।
লেখক, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ কোর্ট, ঢাকা।