সরকারের কাছে খুব দরকারি বলে সরকারি চাকরিজীবীদের আদর-কদর কেবল বাড়ছেই। অবিরাম বাড়ছে বেতনসহ নানা সুযোগ- সুবিধা। অথচ টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষ। তাই বিশ্বের অনেক দেশেই এই শ্রেনীদের জন্য নেয়া হয় ভর্তুকি-রেশিনিংসহ বিশেষ অনেক ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও আছে ট্রাকে করে কম দামে মাথা গুনে কিছু পণ্য বিক্রি সীমিত আয়োজন। সরকারের বেশি ভাবনা সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের নিয়ে।
সেই ভাবনা-চিন্তার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের জুলাই থেকে ১০শতাংশ পার্সেন্ট বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা। নির্বাচনের বছরে নতুন করে এই ঘোষণা নিয়ে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকুরীদের উপরিসহ তাদের কারো কারো যে কামাই তা রোজগার তুলনায় ঘোষনা করা বেতন বৃদ্ধি কোনো টাকাই নয়। তারপরও এটি সরকারিদের প্রতি সরকারের নেক নজরের একটা স্মারক।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে বক্তব্যের সময় সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ নতুন করে প্রণোদনা দেওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীও বাজেট ঘোষণার আগে মে মাসের মাঝামাঝি এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হবে। এখানে স্বচ্ছতা বা লুকোচুরির কিছু নেই। বার্ষিক বৃদ্ধি ৫ শতাংশ ও নতুন প্রণোদনা ৫ শতাংশ মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় হয়।
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপে যখন সবাই পিষ্ট, নতুন এই ঘোষণার ফলে কিছু সৎ সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটু দম ফেলার অবস্থাতো হলো, কিন্তু বাকি সাধারণ জনগণের কী হবে? তাছাড়া সরকারি কর্মচারীরা এমনিতেই তো দম ফেলছে। তাদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড ইত্যাদিসহ কতো সুযোগ সুবিধা আছেই। বাজেট সংক্ষিপ্ত–সার ২০২৩-২৪ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। বাড়তি প্রণোদনার জন্য অর্থ নেওয়া হবে থোক বরাদ্দ থেকে। তাদের জন্য থোকায় থোকায় আরো অনেক কিছু রাখা যেন সরকারের প্রধান দায়িত্ব। অবস্থা অনেকটা এমন যে, তারা ভালো থাকলেই দেশ ভালো থাকে।
বেসরকারি বা বাকিদের জন্য কিছু না রাখলেও চলে। ফলে এই মানসিকতায় দেশে আয়বৈষম্য আরও বেড়েছে। পাশাপাশি ধনীদের আয় আরও বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী, ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ চলে গেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এসব হিসাব না দিলেই কী হতো? গত এক যুগে দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, সঙ্গে দ্রুতগতিতে বৈষম্যও বেড়েছে। বৈষম্যের নির্দেশক গিনি সহগ সূচক এখন দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। দশমিক ৫০০ পয়েন্ট পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ উচ্চ বৈষম্যের দেশের দারপ্রান্তে এখন বাংলাদেশ।
বলা হয়ে থাকে, দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির গিনি সহগ সূচক দশমিক ৬৫। আর সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে আছে সুইডেন, ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। এসব দেশে গিনি সহগ সূচক ৩০-এর আশপাশে।
পিছনের দিকে তাকালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই গরিব মানুষের আয় দেশের মোট আয়ে অংশীদারত্ব এখনকার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ২ দশমিক ৮০ শতাংশের মতো আয় করত সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। পরের ১০-১২ বছরে এই অংশ কিছুটা বেড়েছে। এরপর ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এবারের জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি এক ভাগ। সামনে তা আর বাড়লে বা কমলে কতোই বা বাড়বে। কমারও তেমন জায়গা নেই।
একদিকে যেমন সরকারিদের কামাই রোজগারসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। আরেকদিকে, বেসরকারিদের বিষয়ে সরকারের যেন কিছু করণীয় নেই। বর্তমান পরিস্থিতিটা বেসরকারি খাতের কর্মীদের বড় আক্ষেপ ও বেদনার। কেন যে সরকারি চাকরি নিলেন না- এ দীর্ঘনিশ্বাসও আছে কারো কারো। একটা সময় পর্যন্ত ভালো বেতনসহ হকহালালি কামাই-রোজগার প্রশ্নে অনেকের পছন্দের শীর্ষে ছিল বেসরকারি সেক্টর। তখন পর্যন্ত সরকারিতে এতো বেতন-সুযোগ সুবিধা ছিল না। এখন একেবারে ভিন্ন চিত্র। ১৯৯০-এর দশকে দেশের বাজার যখন উন্মুক্ত হলো, তখন বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি চৌকস তরুণদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছিল। তখন অনেক চৌকস তরুণ সরকারি চাকরিতে যেতে চাইতেন না। কারণ, সেখানে বেতন কম ছিল; বরং উচ্চ বেতনের স্মার্ট করপোরেট চাকরি ছিল তাঁদের আরাধ্য। কিন্তু তিন দশকের মধ্যে পরিস্থিতি ব্যাপক বদল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা না করে বিসিএসের জন্য উন্মাতাল। তারা পদ-পদবিতে শাসক-প্রশাসক, কর্তা, মহাশয়। আর বেতনসহ কামাই রোজগার-শান শওকত অন্য উচ্চতায়। সহপাঠী বেসরকারি বা সরকারি চাকরি না পাওয়াদের জন্য এটি কতো কষ্টের, অপমানের জানেন কেবল ভুক্তভোগীরা।
সরকার চাইলে বেসরকারি খাতের বেতন নিয়ে কি কিছু করতে পারে না? প্রশ্নটি সম্প্রতি বেশ আলোচিত। সরাসরি কিছু না করলেও বেসরকারি খাতের বেতন-ভাতার বিষয়ে অনেক দেশেই সরকারের দিকনির্দেশনা থাকে। সেটা মানা হচ্ছে কি না, তাও সরকার দেখে। উন্নত দেশে সরকার ট্রেন, বাস ও মেট্রো কোম্পানিকে ভর্তুকি দেয়। বিভিন্ন খাতে কর্মরত কর্মীদের বাধ্যতামূলক সবেতন, ছুটি ও পেনশন নিশ্চিত করে। যা পরোক্ষভাবে বেসরকারিদের মজুরি বা বেতন ও অন্যান্য সুবিধায় সরকারেরই পদক্ষেপ। কিন্তু, বাংলাদেশে বেসরকারি খাত অনেকটা সরকারের নজরদারিমুক্ত। আবার কোথাও কোথাও অযাচিত নিয়ন্ত্রণও আছে। সর্বশেষ পে-স্কেল বাস্তবায়নের পর সরকারিদের সঙ্গে বেসরকারিদের বেতনের ব্যবধানটা কোথাও কোথাও আধাআধি পর্যায়ে। তাদের জন্য তো বাজারে কম দামের আলাদা ব্যবস্থা নেই। জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে কেউ কেউ পরিবার-পরিজন শহর থেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, সেটি মোটেই সমাধান নয়।
বেসরকারি খাতই অর্থনীতির প্রাণ, জিডিপির সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে; সরকারি খাত থাকে মূলত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পরিকল্পনায়। বেসরকারি খাতের জন্য সরাসরি কিছু করতে না পারলেও মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে সামান্য স্বস্তি আনতে এই খাতের জন্য সরকার চাইলে কিছু নির্দেশ দিতে পারে। বেসরকারি খাতকে দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরিসহ কিছু শর্ত আরোপ করতে পারে। উল্লেখ্য সরকারিদের জন্য অবসরের পর পেনশন আছে। বেসরকারি খাতের জন্য সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা এখনো দেশে নেই।
সরকারি কর্মচারীরা জাতীয় বেতনকাঠামো ২০১৫ অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান, যে কাঠামো কার্যকর হয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে। সরকারি চাকরিতে ধাপ বা গ্রেড ২০টি। প্রথম ধাপে বেতন-ভাতা পান সচিবেরা। ২০ ধাপের মধ্যে তাদের মূল বেতনই নির্ধারিত ৭৮ হাজার টাকা। আর শেষ অর্থাৎ ২০তম ধাপের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। সেখানেও কিছুটা বৈষম্য আছে।
রাষ্ট্রের চোখে সবাই ‘সরকারি কর্মচারী’ হলেও অর্থ বিভাগ আবার প্রথম থেকে দশম ধাপ পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের ‘কর্মকর্তা’ হিসেবে গণ্য করে থাকে। আর একাদশ থেকে ২০তম ধাপের সরকারি কর্মচারীদের গণ্য করা হয় ‘কর্মচারী’ হিসেবে। কাগজ-কলমের উপরোক্ত হিসাব ও পদবন্টনের বাইরে প্রশিক্ষণের নামে ফরেন ট্যুর, কেনাকাটা, উপরি কামাইসহ তাদের রোজগার আরো বহুমুখী। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার জানিয়েছিলেন, বিদেশে টাকা পাচার, বেগমপাড়ায় বাড়ির মালিকদের বেশির ভাগই আমলা। সংসদে বিরোধী দলের এক সদস্য আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন, এখন বড় বড় রাঘববোয়ালরা টাকা বা ডলারে ঘুষ খান না। ঘুষ নেন সোনার বারে। এই সদস্য মূলত বলতে চেয়েছেন, পাচার কর্মে রাজনীতিকদের চেয়ে আমলারা এগিয়ে।
পাবলিক সার্ভেন্ট কথাটির অর্থ গণভৃত্য। সংবিধানে ‘পাবলিক অফিসারকে’ ‘সরকারি কর্মচারী’ বলা হয়েছে। অহংবোধ থেকে ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি আমলাদের সৃষ্টি। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রকৃত অর্থেই নিজেদের জনগণের সেবক মনে করতে হবে। নিজেদের কর্ম, দায়িত্ব, ক্ষমতা, এখতিয়ার, ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। বাস্তবিক অর্থে বেশীর ভাগ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা কি তা মানেন?
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দুর্নীতি স্বাভাবিক। রাজনীতিতে দুর্নীতি আছে। বিপুল অর্থ ছাড়া কারও রাজনীতি করা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে সম্ভব নয়। দুর্নীতির মাধ্যমে সহজেই অর্থ আয় সম্ভব। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যা আয় করেন, তা আবার জনগণের পেছনেই ব্যয় করেন। আমলাদের দুর্নীতি ভয়াবহ। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদিতায় ভরপুর। যার ফলে সেবাগ্রহীতাদের জীবনকে তাঁরা দুর্বিষহ করে তোলেন। তবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের অভাব আমলাদের দুর্নীতির জন্য বহুলাংশে দায়ী। আমলারা সংখ্যায় রাজনীতিবিদদের থেকে অনেক বেশি। রাজনীতিবিদেরা সাময়িক। আমলারা স্থায়ী। অপ্রিয় হলেও সত্য অনেকাংশে সরকারের ক্ষমতা আমলাদের নথিতেই আটকানো থাকে। আর এই ক্ষমতাই দুর্নীতির উৎস। তাই অতিতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে আমলাদের দুর্নীতি এখন অধিক দৃশ্যমান। তবে সব রাজনীতিবিদ যেমন দুর্নীতিপরায়ণ নন। সব সরকারি কর্মচারীও দুর্নীতিপরায়ণ নন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশি লক্ষনীয় বিষয় বেশীর ভাগ দূর্নীতিবাজ আমলারা চাকুরির মেয়াদ শেষ হলেই অর্থের বিনিময় আবার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ এবং রাজনীতিতে যোগদেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
তবে দেশে পাচার-ঘুষ, দুর্নীতি এখন এক ধরনের নীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা, হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া এক ধরনের যোগ্যতা। এই ক্ষেত্রে অবশ্য শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের দায়ী করা ন্যায্য হয় না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপ্রকাশিত সত্য রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের ইউনিয়ন কমিটিতে জায়গা পেতেও টাকার বিষয় রয়েছে। নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে লেনদেন হয় এবং নির্বাচনী বৈতরণি পার হতেও টাকার খেলা চলে। যেখানে সরকারি-বেসরকারি- রাজনীতিবিদের সীমানা টানাও কঠিন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।