উপ-সম্পাদকীয়
মোহাম্মদ সফিউল হক :
“কত বর্ষ হবে গত, কত সূর্য হবে অস্ত/ আছিল নূতন যাহা পুরাতন হবে।” কালের অমোঘ নিয়মে চলে গেলো ২০২৩। বিদায়ী বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-সংঘাত, পাওয়া-না পাওয়া, অর্জন-বিসর্জন সবকিছুই ঠাঁই নেবে স্মৃতির পাতায়।মহাকালের গর্ভে একটির পর একটি বছরের বিলীন হলেও ‘কালের যাত্রার ধ্বনিতে’ কালপ্রভাতে ‘রবির কর’ পুবে আলোকের নাচন তুলে চোখ মেলবে নতুন দিনে, নতুন বছরে। বিদায়ী বছরের পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেবভূমিতেই রচিত হয় নতুন স্বপ্ন-আশা, নতুন বছরের পথচলা। আর নতুনের মাঝেই থাকে পরিকল্পনা,স্বপ্ন,আশা-ভরসা,থাকে ভালো কিছুর প্রত্যাশার দীর্ঘ ফর্দ।
দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, মানবসম্পদ উন্নয়ন সহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিষ্ময়কর সাফল্য পেয়েছে।তবুও বিদায়ী বছরে সুখকর ঘটনায় পুলকিত হওয়ার চেয়ে অনাকাঙ্খিত ঘটনায় হৃদয় ভারাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেশি।অনেক স্বপ্ন সত্যি হয়েছে আবার অগনিত স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে আতুড় ঘরেই। জীবন জুড়ে প্রাপ্তির সাথেই আছে না পাওয়ার হতাশা। হতাশাকে মাড়িয়ই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নতুনের আহবানে।‘যা চেয়েছি তা পাইনি, পেয়েছি যা চাইনি’-কে ভুলে গিয়ে দেশ-জনতার উন্নয়নে,নব উদ্যোগে-উচ্ছ্বাসে এবার বলতে চাই যা চেয়েছি তা পেয়েছি,আর যা পাইনি তা এবার পাবোই ! সে সব প্রত্যাশারই কিছু কথা তুলে ধরছি।
জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাঃ আমরা জানি গণতন্ত্রে জনগণই সর্বেসর্বা। গণতন্ত্রের মৌল অর্থই হচ্ছে জনগণের শাসন। আমাদের সংবিধানেও জনগণকে প্রজাতন্ত্রের মালিক বলা হয়েছে। আমরা জানি ক্ষমতায় যাওয়ার উৎসও হচ্ছে জনগণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জনগণের কোন চাওয়া-পাওয়ার খুব কম মূল্যই দিয়ে থাকে আমাদের শাসকবর্গ। জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যাথা নেই। গুম, খুন দেদারসে চলছে। বিচার ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটাধিকার প্রয়োগের অবস্থা খুবই নাজুক।
মতাবস্থায় আমরা আশা করব নতুন বছরে কারো পক্ষ থেকেই জনমতের প্রতি কোনরূপ অশ্রদ্ধা দেখানো হবে না। কেননা, জনমতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কখনো সম্মানিত হওয়া যায় না। দুর্নীতির অবসানঃ বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতি দূর করা। আমরাও আশা করেছিলাম সেই অঙ্গীকারের কিছু না কিছু বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু বেশ কিছু দিকে ঘটেছে তার উল্টো। পদ্মা সেতু, হল মার্ক, সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কথা বলাই বাহুল্য। এসবের পরেও আমরা ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকব এবং আশা করব একদিন দুর্নীতির অবসান হবে এবং সুজলা-সুফলা এই বাংলাদেশ হবে এক স্বনির্ভর নতুন বাংলাদেশ।
আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষাঃ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য যেমন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন হচ্ছে একটি সুশিক্ষিত জাতি তৈরি করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে মান বজায় রাখার কোন চিন্তা কারো মাথায় নেই অপর দিকে শিক্ষাঙ্গনে মানুষ হবার কোন পরিবেশ নেই।মানুষকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করার শিক্ষা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।।শিক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিক বা আদর্শিক দিকটা বার বার উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস ও নকলপ্রবণতার মতো মারাত্মক বিষয়গুলো। সমকালীন মানুষের শিক্ষা ও নৈতিকতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন- “শিক্ষা এখন সোলেমানি আংটির মতো। ঘষা দিলে আলাদিনের দৈত্য আসে এবং সব রকমের ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে যায়।” আহমদ শরীফের কথায় একটু শ্লেষ আছে। শিক্ষাকে বর্তমানে ইচ্ছাপূরণের চাবি বানিয়ে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন করে ফেলা হয়েছে বলেই তার কথা থেকে মনে হয়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ডাকাতদের গ্রাম’ বলেতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক অন্তঃসারশূন্য অবস্থা ফুটে উঠেছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের কথায়- “ডাক্তারী মতে ‘ক্লিনিক্যালি’ জীবিত বলে রোগীর যে অবস্থাটা বোঝানো হয় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা তাই। মৃত্যুর সব চিহ্ন প্রকট, সর্ব শরীর অসাড়, সর্ব ইন্দ্রিয় নিস্ক্রিয়, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াহীন তবু মৃত্যু ঘটেছে বলা যায় না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও আজ সব অর্থে বিকল।
গোটা দেশ জুড়ে বিরাট একটা কাঠামো পড়ে আছে গল্পের দানবের মতো। গল্প হচ্ছেঃ দানবের হা মুখ এতো বিরাট যে কেউ পায়ে হেঁটে পেট পর্যন্ত পৌঁছে এতটুকু স্পর্শিত না হয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও সম্ভব যে দেশের একজন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষায় ঢুকে উচ্চ শিক্ষার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে আসতে পারেন শিক্ষা বস্তুটি দ্ধারা এতটুকু স্পর্শিত না হয়ে। মানুষকে এমন চরম অপদার্থ ও অকর্মণ্য বানাবার কারখানা দুনিয়ার আর কোথায় আছে আমার জানা নাই।” এ প্রেক্ষিতে আমরা আশা করব এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি যুৎসই নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সংশ্লিষ্ট সকলেই যথাযথ ভূমিকা রাখবেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন : মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল তাদের প্রত্যেকের তীব্র আকাঙ্খা ছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বৈষম্যহীন সুদৃঢ় ঐক্যের বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না কোন শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন; থাকবে দেশের প্রতি, দেশের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি অপার ভালবাসা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার, জাতীয়তাবোধ ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করা। সেটা রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা অর্থনৈতিক ইস্যু যাই হোক না কেন। এসব ব্যাপারে জনগণকে যেমন সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে পক্ষান্তরে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিগণকে আরো ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধকরণ: মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে আজও নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এসব ঘটনা নিয়ে দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হল দেশে বিচারের নামে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থকরণের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব অনাকাংখিত অবস্থার অবসান আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও হলুদ সাংবাদিকতার অবসান : সংবাদ মাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। এ ব্যাপারে আমি দুইটি দিক তুলে ধরব। প্রথমটি হলো সত্যনিষ্ঠ অনেক সংবাদ মাধ্যম আজ রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশের এমন অবস্থা দেখে যে কোন বিবেকবান মানুষ আজ স্তম্ভিত ও লজ্জিত। দ্বিতীয়ত আমরা আশা করেছিলাম দেশে হলুদ সাংবাদিকতার অবসান হবে। কিন্তু আমাদের আশার গুড়ে বালি। এমন অবস্থা দেশের ভবিষ্যতের জন্য আমরা স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম ও হলুদ সাংবাদিকতার অবসান চাইবো। আমনরা সংবাদ মাধ্যমে সঠিক সংবাদ পেতে অশনি সংকেত বহন করে যা দেশ ও জাতির জন্য আদৌ কাম্য নয়।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান : আমরা সর্বদাই গণতন্ত্রের কথা বলে থাকি। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসকদের রুদ্র রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে। সাম্প্রতিক সময়ে জনগণের এক বিরাট অংশ মনে করে দেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষ মৃত । আমাদের এই দুর্বলতা অবশ্যই স্বীকার করে নেয়া উচিত যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন- এগুলোকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হইনি। সেই প্রেক্ষিতে আমরা বিশ্বাস করি যে, যারা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে এবং সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে তারাই কেবল এই দেশ শাসনের সুযোগ লাভ করতে পারে।
আমরা উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত পথ চাই। বিগত দিনের ব্যর্থতা, হতাশা আর বঞ্চনার অবসান চাই। তাই এই জাতির প্রত্যাশার কিছু দিক তুলে ধরলাম। তবে সেসব দিকে জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস পরিচালিত না হলে সাফল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। এজন্যে জাতীয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভক্তি দূর করা ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। নির্বাচনকালীন সরকার কিংবা অপরাপর বিষয়ে জাতীয় আদর্শের নিরীখে জাতীয় বিভক্তি দুর করা আজ সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবী। সময়ের প্রয়োজনে এদাবী পূরণে আমাদেরকে আবারো একটি যুদ্ধে অবর্তীণ হতে হবে। এজন্যে ভিনদেশী সেবাদাস মুক্ত, দেশপ্রেমিক, নৈতিক মান সম্পন্ন একটি জনগোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম নিয়ে সঠিক সময়েই প্রতিভাত হবে, আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে উঠবে চিত্ত।’নতুন বছরে এই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : ব্যাংকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।