উপ-সম্পাদকীয়
জাহাঙ্গীর আলম :
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে মানুষের জন্য সামাজিক শুদ্ধাচার অর্জন করা অপরিহার্য। যেখানে সামাজিক শুদ্ধাচারের অভাব পরিলক্ষিত হয় সে সমাজ ধীরেধীরে বহুবিধ অনিয়ম -দুর্নীতি ও পাপাচারে নিমজ্জিত হয়। খুন-খারাবি, অন্যায়-অবিচার, জুলম-শোষণ,অবাধযৌনচার সমাজের কণ্ঠকে চেপে ধরে। তাই সমাজজীবনে সামাজিক শুদ্ধাচার অপরিহার্য। এক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষা মানুষকে মানবিক গুণে উজ্জীবিত করে। মানুষকে পশুবৃত্তি থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। নৈতিকতা পরিপন্থী শিক্ষা মানবজীবনে কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। সে অর্থে যে শিক্ষা মানবজীবনের সুকুমার মানবীয় গুণাবলী গুলো বিকশিত করতে ব্যর্থ হয় তাকে শিক্ষা বলাও ঠিক হবে না। নৈতিকশিক্ষা মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা কেবল মানবসমাজেই রয়েছে। মূল্যবোধ মানবজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মহান গুণাবলী যে মানুষ অর্জন করতে অথবা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, তাকে আকৃতিগত দিক থেকে দেখতে মানুষের মতো মনে হলেও, বাস্তবিক পক্ষে সে ক্রমাগত পশুত্বে ডুবে যেতে থাকে। মানবীয় আচরণবিধি লঙ্ঘন করে উচ্ছৃঙ্খল ও পেশীশক্তির মহড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই জন্মের পর থেকে একজন মানবসন্তানকে মূল্যবোধ অর্জনের প্রশিক্ষণে অবতীর্ণ হতে হয়। মূলত শিশুর মাতৃক্রোড়ে অবস্থান কালে অর্থাৎ দুগ্ধপানকালীন সময় থেকে নীরবে মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে।ধীরে ধীরে বাবা, ভাই, বোনসহ পরিবারের অপরাপর সদস্যদের আচার আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে রপ্ত করতে থাকে ছোট্ট শিশুটি। আমরা বুঝতে পারি আর নাই পারি কোমলমতি শিশুরা যা দেখছে, যা কিছু নিজের কানে শুনছে তাই অবলীলাক্রমে শিখে নিচ্ছে।
পরিবারে বড়দের প্রত্যহিক জীবনকর্ম,ভাষা-ব্যবহার সব কিছু সে অনুকরণীয় ভাবে অর্জন করে নিচ্ছে। এই শিক্ষাই শিশুজীবনের মৌলিক ফাউন্ডেশন। একে বলে পারিবারিক শিক্ষা। যে পরিবার শিশুদের সাথে ও সম্মুখে দায়িত্বপূর্ণ, শালিন ও ভদ্র আচরণ করে তারাও তেমন বৈশিষ্ট্যময় চরিত্র নিয়ে বেড়ে ওঠে। অবশ্যই এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকাই বেশি। তাই মাকে সন্তানের “প্রাথমিক শিক্ষক” বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত পক্ষে মায়ের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে একটি মানব শিশুর জীবন।
একটু বড় হলে এই শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে থাকে। তখন শিক্ষা অর্জনের পরিধি ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমন্বিত প্রয়াসে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ গড়ে উঠতে থাকে।
শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নত জাতি সৃষ্টি করা, যে জাতির প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেম, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সর্বোপরি মানবপ্রেম বিরাজ করবে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যে বসবাস করার প্রধান শর্ত হচ্ছে একে অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা করা এবং একে অপরকে এই অধিকার ভোগ করতে সাহায্য করা। তাইতো সমাজের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে শিক্ষার চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া উচিৎ।
আর এই মূল্যবোধের শিক্ষা থেকে একজন শিক্ষার্থীর শৈশব বয়স থেকেই সঠিক সিদ্ধান্তই এক সময় তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের লক্ষ্য হলে আর যাই হোক, তা দিয়ে দেশের উন্নতি আশা করা যায় না। শিক্ষাকে শুধু টাকা উপার্জনের মাধ্যম মনে করলে ভুল হবে। আমাদের সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দের মাঝে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। শিশুদেরকে শিশুকাল থেকেই একজন আদর্শ মানুষ, ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার বিপরীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ, ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে উৎসাহিত করেন। অর্থাৎ অঢেল অর্থ আয়ের মানসিকতা শিশুদের মাঝে জাগ্রত করে দেন। ফলে একজন আলোকোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী ও মুক্ত মনের মানুষ হওয়ার ইচ্ছেটুকু তাদের মন থেকে অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে ক্রমেই ভোগবাদী মনোভাব জেগে ওঠে। এজাতীয় চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
মানুুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধ বা মানবীয় মূল্যবোধ না থাকলে তাকে মানুষ বলা যায় না। তখন মানুষ আর পশুতে কোন পার্থক্য থাকে না। কারণ,পশু স্বাভাবিক ভাবেই পশু, মানুষ প্রাণ পণ চেষ্টায় তবেই মানুষ। মানব শিশু আর পশুর মাঝে পার্থক্য হলো পশু জন্মের পর পরই পশুত্ব প্রদর্শন করতে পারে। কিন্ত মানব শিশু মনুষ্যত্ব প্রয়োগ করতে পারে না।তাকে অর্জন করতে হয়। তাই পশু শাবকে বলার প্রয়োজন হয় না যে, পশুর মতো পশু হও,কিন্তু মানব শিশুর উদ্দেশ্যে বলতে হয় মানুষের মতো মানুষ হও।
প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী “মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সাথে তুলনা করেছেন। জীবসত্ত্বা সে ঘরের নিচের তলা, আর মানব সত্ত্বা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্ত্বার ঘর থেকে মানবসত্ত্বার ঘরে ওঠার মই হচ্ছে শিক্ষা।’ এই মানবসত্ত্বার ঘরেই মূল্যবোধ বাস করে। ভালো মনের মানুষ হওয়ার কথা যে, মানুষ চিন্তা করতে পারেনা, তার অন্যতম কারণ,” মানুষ অর্থচিন্তার নিগড়ে বন্দি।
সবার মনে একটাই কথা আরো চাই,আরো চাই। এ চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে না পারলে মানব জীবনে শিক্ষা সোনা ফলাতে পারবেনা। তাই ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। জীবীকার যোগান নিয়ে মানুষকে যদি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়, তাহলে মানবীয় মূল্যবোধ নিয়ে টিকে থাকা দায়। কারণ, অভাবে স্বভাব নষ্ট। পেটে ক্ষুধা নিয়ে আর যাই হোক মূল্যবোধের অনুশীলন করা যায় না। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটা অংশের মূল্যবোধ অবক্ষয়ের জন্য ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্য’ অন্যতম কারণ ‘চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে নেই সেখানে মুক্তি নেই।’
মূল্যবোধের বিভিন্ন পর্যায় বা শ্রেণিভেদ রয়েছে-
এক. পারিবারিক মূল্যবোধ। দুই. সামাজিক মূল্যবোধ।
তিন. নৈতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ। চার. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।
পাঁচ. আচরণগত বা বাচনিক মূল্যবোধ। ছয়. রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ।
সাত. আদর্শিক মূল্যবোধ। আট. মানবিক মূল্যবোধ।
যাবতীয় মূল্যবোধই ব্যক্তি জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজস্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা গৌরবকে ধরে রাখতে আপন সংস্কৃতিকে লালন করতে যেমন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি বৈশ্বিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। পারিবারিক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের যথাযথ মূল্যায়ন করার বোধ বা ক্ষমতা অর্জিত হয়। এই শিক্ষাটি সব ধরণের মূল্যবোধের সমারোহ ঘটিয়ে থাকে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা একজন শিশুকে বিকশিত করে আলোকিত মানুষের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
মূল্যবোধ মানব জীবনের সবচয়ে বড় সম্পদ। একটি শিশুকে আচার-আচরণ শিক্ষার পাশাপাশি মূল্যবোধ শিখানো হয় নানাভাবে। শিষ্টাচার, আদব, বিনয়-নম্রতা, সালাম, সততা, ত্যাগ,সত্যবলা,বিদায়ের সময় শুভকামনা করা, ধন্যবাদ জানানো ইত্যাদির মাধ্যমেই শিশুকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয়। পরিবারে যে শিক্ষা শিশু গ্রহণ করতে থাকে তা পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে স্থায়িত্ব লাভ করে। শিশুশ্রেণি থেকে সেই শিশু শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম, দয়া, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, সম্প্রীতি ও মানবতাবোধ জাগ্রত করতে শিক্ষা ব্যবস্থায় সময় উপযোগী নানান কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। জাতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই মূল্যবোধের শিক্ষায় সমৃদ্ধ করতে হবে। শিক্ষা শুধুমাত্র মানোন্নয়ন নয়, একটি সভ্য ও উন্নত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষাকার্যক্রমে বিজ্ঞানমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুকে অনবরত প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে না নিয়ে তার মাঝে সামাজিক গুণাবলীর সমারোহ ঘটাতা হবে। বয়স অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠদান কর্মসূচি ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষাকার্যক্রম চালানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন একটি মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে তেমনি মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতিকে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে তৈরি হবে। এর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে হবে। আমরা এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাই না, যেখানে শিক্ষা অর্জন করতে এসে সামান্য কোন কারণে একজন শিক্ষার্থী অন্য জনকে মারতে উদ্যত হয়,লাশ হয়ে ফিরে আসে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি ও অমর্যাদাকর পরিবেশ তৈরি হওয়া শিক্ষা ও মূল্যবোধের জন্য কোনভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গড়ার কারিগর। মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষক হলেন দ্বিতীয় জনক। শিক্ষকতার জায়গায় থেকে কেউ যদি অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন তা অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য। কিন্ত সার্বিক ভাবে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা এখন বহুলাংশে তলানিতে নেমে এসেছে। এর পেছনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বোধ জড়িত। এ দায়ভার কোন ভাবে এড়ানো সম্ভব নয়।
একজন আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা পোষণ করতে শুরু করে। জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে অর্থ ও ক্ষমতার মোহে পড়ে যায়। রাষ্ট্র এবং সমাজে শিক্ষক সম্প্রদায়কে সম্মানের স্থানে রেখে মূল্যায়ন না করলে কোন স্তরে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে না।বিভিন্ন কারণে শ্রেণিকক্ষে এখন শিক্ষকগণ অসহায়। অপরাধের কারণে যদি কোন শিক্ষার্থীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসেন, তখন নোংরা রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে শিক্ষক নাজেহাল হতে হয়। সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হয়। এর জন্য কারাবরণও করতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরিও হারাতে হয়। এটা জাতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে চরম বিপদ সংকেত। তবে শিক্ষক যদি রাগ- বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে থাকে তা কোন ভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়।তাই বলে গোটা শিক্ষক সমাজকে সাক্ষীগোপাল বানিয়ে জাতির মূল্যবোধে কুঠারাগাত করা চলে না। একই কারণে এখন অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ ছাত্রদের বাহু ও সিনার আঘাত সহ্য করে নিচের দিকে তাকিয়ে নীরবে বাড়ি চলে যেতে হয়। এটিও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। মূল্যবোধকে সু-প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষক ও শিক্ষাকে স্বকীয় মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এর অন্য কোন বিকল্প নেই।
শিক্ষা অর্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি সেই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধূরী তাঁর ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি। জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে।তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া হয় না , সেখানে শিক্ষা প্রয়োজন নাই।’
নানাবিধ কারণে সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে থাকে, এর নেপথ্যের উল্লেখযোগ্য প্রাসঙ্গিক কারণগুলোর মাঝে অন্যতম হলো-দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা, পারিবরিক অসচেতনতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা, দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্য, সামাজিক নৈরাজ্য ও অস্থিরতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারীতা,ক্ষমতা ও নেতৃত্বের অপব্যবহার, অসৎ নেতৃত্ব, ভোগবাদী মানসিকতা, অবমূল্যায়ন, মাদকে আসক্তি, প্রযুক্তির (মোবাইল ফোন, ফেইসবুক, ইন্টারনেট) অপব্যবহার প্রভৃতি।
গুম, খুন,অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ, নারী ও শিশু পাচার, খাদ্যে ভেজাল, শিশু নির্যাতনসহ নানাবিধ অপরাধ কেবল মূল্যবোধের অবক্ষয় জনীত কারণেই সংগঠিত হচ্ছে। ঘুণে ধরা, নিয়ন্ত্রণহীন, বৈষম্যে জর্জরিত এই অস্থির সমাজব্যবস্থার দায় ‘শাসনব্যবস্থা’ তথা ‘রাষ্ট্র’ কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। এ দায়িত্ব রাষ্ট্রেকে নিতেই হবে। যদিও এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের একার নয়, সব নাগরিকের। কিন্তু সকল নাগরিককে সচেতন করে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ রাষ্ট্র এখানে বরাবরের মতোই নির্বিকার। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে সমাজের রন্ধ্রেরন্ধ্রে এখন বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস প্রায় শূন্যের কোঠায়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সমাজকে সক্রিয় হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে জাগ্রত করতে হবে সমাজকে। সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক স্থিতিশীলতা। প্রয়োজন নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ সাধন। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপাদান তথা সততা, কর্তব্য, ধৈর্য, শিষ্টাচার, উদারতা, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি মানবীয় গুণের চর্চা বর্তমান সমাজের অনেকাংশে নেই। সমাজ চলছে বিপরীত স্রোতের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি বা সুবিচার না হওয়ার কারণে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা দিন দিন যেন আরো সাহসী হয়ে উঠছে। এটাও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
এই মহাসমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে একসাথে, একই মেরুকরণে এসে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে যথাযথ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। তাহলে আমরা একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করতে পারবো। তখন সমাজের সকলস্তরে মানবীয় গুণাবলী বিকশিত হবে। মানুষ সমাজিক শুদ্ধাচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাপাচার ও পঙ্কিলতা মুক্ত হবে। সমাজের মানুষ তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার ফিরে পাবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।