উপ-সম্পাদকীয়
মোহাম্মদ সফিউল হক :
শীতের বার্তা এসেছে আমাদের দুয়ারে। এদেশে পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল। যদিও আগেভাগেই শীত তার আসার কথা জানান দেয়। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে শীত বছর ঘুরে আসবে এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তবে শীতের দাপট সব বছর সমান হয় না। কোনো বছর বেশি, কোনো বছর অপেক্ষাকৃত কম। দেশজুড়ে শীতের মাস পৌষেই হিমেল হাওয়ায় প্রকৃতিতে নামে নীরবতা। নেমে আসে এক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন শিশির সকাল কিংবা ভোর। কুয়াশাঘেরা বর্ণিল প্রকৃতিতে শীত আসে এক অন্যরকম আবেদন নিয়ে। এসময় রসেভরা পিঠাপুলি আর পায়েসের উৎসবে মেতে ওঠে অনেকে। অবসন্ন কুয়াশা কিংবা মায়াময় রোদের আমেজ এ শীতেই ধরা দেয়।
কুয়াশার চাদরে শস্যহীন মাঠ আর পাতাঝরা গাছের মলিনতা থাকলেও, ঘরভরা সোনালি ফসল অনেকের মনেই এনে দেয় পূর্ণতার অনাবিল আনন্দ। ক্ষণিককালের এই শীত মানুষের মনে পরশ বুলিয়ে দেয়, রেখে যায় কোমল কঠিন স্পর্শ। পৌষের এই দিনগুলোতে উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে শীতবুড়ির হিম শীতল নিঃশ্বাস। ধরণী হঠাৎ হয়ে পড়ে জড়সড়। বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলোয়। শীতের দীর্ঘ রাতের কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। তখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে মানুষের। ঠাণ্ডা পানিতে অজু করে নামাজে দাঁড়ায় বড়রা। ছোটরা লেপের নিচে দাদা-দাদির গা-ঘেঁষে গল্প করে, ছড়া কাটে মিষ্টি সুরে। শীতের দিনে এ স্মৃতিগুলো সত্যিই অসাধারণ!
শীত যেমন বাহারি আনন্দ বয়ে আনে, ঠিক তেমনি অনেকের জন্য বয়ে আনে অনাবিল কষ্টও। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল, চর, হাওরাঞ্চলসহ শহরের ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ক্ষণস্থায়ী এই শীত আসে অভিশাপ হয়ে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। এই শীতে দরিদ্র কৃষিজীবীরা প্রচণ্ড শীতে জবুথবু হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যেই হেমন্তের শেষে হালকা ঠ্ন্ডা রয়েছ। আবহাওয়া অফিস থেকে তীব্র শীতের আভাস দিয়েছে। নগরবাসীর কাছে অবশ্য এই শীত এখনো তেমন তীব্রতায় অনুভূত হচ্ছে না। তবে গ্রামে অনুভূত হচ্ছে প্রচণ্ড শীত। কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাস বাড়িয়ে দিয়েছে শীতের তীব্রতা।
দেশের সব কটি জেলাতেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পেয়েছে, যা তীব্র শীতের অন্যতম কারণ! এই শীতের প্রকোপে দুস্থ, ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত, ও হতদরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষদের দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটে, জনজীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। শীতবস্ত্রের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় তাদের। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতবস্ত্রের অভাবে বিপাকে পড়তে হয়। এই শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজন হয় উষ্ণতার পোশাক। কিন্তু, গরিবের ভাগ্যে জোটে না সেই পোশাক। অথচ বিত্তবানদের গেল বছরের শীতের পোশাক থাকা সত্ত্বেও এই বছর হাজার খানেক টাকা দিয়ে শীতবস্ত্র কেনা হয়ে গেছে। সমাজের অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি আমাদের কোনো খেয়াল নেই বললেই চলে। অথচ তারা তাকিয়ে থাকে ধনীদের সহায়তার দিকে, মানবতার দিকে। কিন্তু, শীত ঋতুর সব ভালো দিকটাই যেন বিত্তশালীদের জন্য। শীতে বাহারি বিলাসী পরিধেয় ফ্যাশন হয় নজরকাড়া।
পক্ষান্তরে শীতবস্ত্রহীন মানুষের দুর্দশার বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ করতে হয়। হতদরিদ্রদের ভাগ্যে শীতের কামড় ছাড়া যেন আর কিছুই জোটে না! শীতের প্রস্তুতি দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর থাকে না বললেই চলে। দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র পরিবারে শীতার্ত মানুষের দুঃখবহ দিনযাপনের করুণ-কঠোর চিত্র খুব অল্পই জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উঠে আসে। আর এলেও তা বেশিরভাগ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয় না। যাদের পেটে ক্ষুধার তাড়না, তাদের শীতের পোশাক জোগাড় করা তো অলীক স্বপ্ন! ফলে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করে দেশের লাখ লাখ দুস্থ, নিঃস্ব, ছিন্নমূল, গরিব, দুঃখী, বস্ত্রহীন শিশু, নারী-পুরুষ। পায় না ঠিকমতো শীত নিবারণের পোশাক। হাড়কাঁপানো শীতে তারা আক্রান্ত হয় সর্দি-কাশি-হাঁচি-জ্বর, শীতকালীন ডায়রিয়ায়। হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও; এর চেয়েও বেশি আক্রান্ত রোগীরা টাকার অভাবে থাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। দুস্থ মানুষের পক্ষে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং চিকিৎসা গ্রহণ এক অসম্ভব ব্যাপার। বাংলা প্রবাদে আছে, কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সুচিকিৎসা, ওষুধপথ্য এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ।
শীত এলেই শীতের নানা সবজিতে ভরে যায় বাজার। দাম হয় অপেক্ষাকৃত কম। অপেক্ষাকৃত কম দাম হলেও দুস্থ মানুষের পক্ষে শীতে উষ্ণতার কাপড় কেনা খুবই কষ্টসাধ্য। কেননা, যে কোনো দুর্যোগ-দৈবপাকে দুস্থ ও ছিন্নমূল মানুষই বিপাকে পড়ে বেশি। শীত এলে তো তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দুস্থ মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। খড়কুটোর আগুন জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায় অনেকে। কেউ আবার জেগে উঠে ছেঁড়া কাগজ জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। বস্তি, ফুটপাত আর রেললাইনে সামান্য কাপড় জড়িয়ে কোনোরকম শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা! কাউকে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হয়। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে তারা থরথর করে। নেই শীত নিবারণের উপযুক্ত আবাসন। চোখের পানি আটকে রাখা খুবই কষ্টকর। প্রকৃতির আচরণ তাদের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। শুষ্ক রিক্ততা আর দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে তাদের কাছে ধরা দেয় শীত। একদিকে শীতবস্ত্র ও লেপ-কম্বল কিনে শীত নিবারণ করা যেমন দুরূহ, অন্যদিকে পুষ্টিহীনতার কারণে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও তাদের কম। ফলে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে তারাই আক্রান্ত হয় বেশি। এসব মানুষের শীতের দুর্ভোগ কমাতে ধনীদের সহায়তার হাত বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।
একটু উষ্ণতার জন্য অপেক্ষায় সুবিধাবঞ্চিতরা। এই শীত প্রভাবশালীদের জন্য আনন্দদায়ক হলেও, একবারও কি ভেবে দেখেছেন; অসহায় গরিব বস্ত্রহীন কর্মে অক্ষম মানুষ কীভাবে রাত কাটাচ্ছে। তাদের গরম পোশাক তো দূরের কথা, সামান্য কাপড়টুকুও নেই। অনেকে এই শীত সহ্য করতে না পেরে মারাও যাচ্ছে। অন্নহীনকে অন্নদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, গৃহহীনকে আশ্রয়দান, নিরক্ষরকে শিক্ষাদান, অসুস্থকে সেবাদান, অসহায় বিত্তহীনকে অর্থদান, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় বিপদ আপদে পতিত দুস্থ মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই শীতে দুস্থ অসহায় ও গরিব বস্ত্রহীন কর্মে অক্ষম মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকের মানবিক দায়িত্ব। তাই আসুন আমরা অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শীতার্তদের পাশে দাঁড়াই।ফেনীতে পথের ফুল ফাউন্ডেশন, সহায়, সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনসহ বেশ কিছু স্বেচ্চাসেবী সংগঠন প্রতিবছর বাড়ায় উষ্ণতার হাত। তাই তাদের সাথে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সামান্য সহযোগিতাই এনে দেবে তাদের উষ্ণতার ছোঁয়া। ফোটাবে তাদের মুখে হাসি। হতদরিদ্র মানুষকে শীতবস্ত্র সরবরাহ সরকারের সামর্থের বাইরে নয়, তবে দরকার সময়োচিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন।
বিত্তবানদের যৎসামান্য ভালোবাসা ও সহানুভূতিই পারে শীতার্ত মানুষের হৃদয়ে উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দিতে।আসুন যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী শীতার্ত মানুষের হৃদয়ে উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দিই।
লেখক : ব্যাংকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।