মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম বিন মুজাদ্দেদী
‘রজব’ ইসলামিক ক্যালেন্ডার হিজরী সনের সপ্তম মাস। মাসটি ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ সম্মানিত চারটি মাসের মধ্যে অন্যতম একটি মাস। (সূরা আত-তাওবা ৩৬; বুখারী হা/৩১৯৭; মুসলিম হা/১৬৭৯) রজব মাসকে কেন্দ্র করে- মুসলিম উম্মাহর মধ্যে/ বিশেষ করে উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে চরম বিভ্রান্তি ও বিদআত প্রচলিত রয়েছে।
বিভ্রান্তি হলো- বলা হয়ে থাকে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে নাবী (সা.)-এর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিলো। অথচ- মি’রাজের তারিখ নিয়ে যথেষ্ট ইখতেলাফ রয়েছে। প্রায় ২০-টিরও অধিক মত পাওয়া যায়। এরমধ্যে ২৬ তারিখ দিবাগত রাত বা ২৭ রজব অন্যতম এবং প্রসিদ্ধ; তবে বিশুদ্ধ নয়। তার মানে সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো- নাবী (সা.)-এর মি’রাজ সংঘটনের পর পরই বা কয়েকদিন কিংবা কয়েক মাস পরই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়নি। তিনি মি’রাজ সংঘটনের পর আরও প্রায় ১১/১২ বছর বেঁছে ছিলেন। ইসরা ও মি’রাজের খুঁটিনাটি বিস্তারিত বলেছেন; যা বিশুদ্ধ সূত্রে হাদীসের কিতাব-সমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু তারিখ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানান নি। জানালে তা অবশ্যই মি’রাজের অন্যান্য ঘটনাবলীর ন্যায় হাদীসের গ্রন্থগুলোতো সংরক্ষিত থাকতো এবং এ নিয়ে কোন মতভেদ-ই সৃষ্টি হতো না। সাহাবায়ে কেরাম, তাবে’ঈন ও তাবে’ তাবে’ঈন/উম্মাহর মান্যবর চার ইমাম থেকেও বিশুদ্ধ সূত্রে কোন নির্দিষ্ট তারিখ বর্ণিত হয়নি।
বিদআত হলো- রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত বা ২৭ তারিখকে লাইলাতুল মি’রাজ সাব্যস্ত করে- ঐ রাত কেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট ইবাদত আমল করা এবং দিনে সিয়াম পালন করা । যার পক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বরকতময় সুন্নাহর কোন দলীল/সাহাবায়ে কেরমগণের আমল বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। আমরা জেনেছি- নাবী (সা.) মি’রাজ সংঘটনের পর আরও ১১/১২ বছর বেঁচে ছিলেন। এ রাতের নির্দিষ্ট কোন ইবাদত আমল যদি থাকতো কিংবা ফযীলতপূর্ণ হতো- তাহলে তিনি কি তাঁর উম্মাতদেরকে জানাতেন না? অবশ্যই জানাতেন।
অথচ- বিশুদ্ধ সূত্রে মি’রাজের সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ কিংবা ইবাদত আমল হাদীসের কিতাবগুলোতে পাওয়া যায়না। যা রয়েছে- তা হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইকারী মুহাদ্দিসগণের গবেষণায় জাল হিসেবে প্রমাণিত।
তাই উম্মাহর আহলে ইলমগণ রায় দিয়েছেন- লাইলাতুল মি’রাজ বা শবেমে’রাজ পালন করা সুস্পষ্ট বিদআত। আর বিদআত মূলত দ্বীন বিকৃতির নামান্তর এবং বিদআতের উপর ভিত্তিশীল সকল আমল প্রত্যাখ্যাত হয়। কবুল করা হয়না।
মি’রাজ কেন্দ্রিক জ্ঞাতব্য : ১) নবী (সা.)-এর ইসরা ও মি’রাজ শতভাগ বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত। বিশ্বাস করা ঈমান আর অবিশ্বাস সুস্পষ্ট কুফর। ২) মি’রাজ নাবী (সা.)- এর মাক্কী যুগের শেষ দিকে, রাতে এবং স্বপ্ন যোগে নয়; বরং স্বশরীরেই সংঘটিত হয়েছে। ৩) মি’রাজের দিন তারিখ বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। ৪)রজবের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত/২৭ তারিখের মতটি ২০/৬ টি মতের মধ্যে একটি প্রচলিত মত মাত্র। ৫)লাইলাতুল মি’রাজ কেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট কোন ইবাদাত-আমল বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। সুতরাং লাইলাতুল মি’রাজ উদযাপন করা/এ উপলক্ষ্যে নির্দিষ্ট কোন ইবাদাত-আমল সুস্পষ্ট বিদআত।
রজব মাস কেন্দ্রিক জ্ঞাতব্য বিষয় : ১) রজব মাস সম্মানিত চারটি মাসের মধ্যে অন্যতম একটি মাস। ২) রজব মাস কেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট ইবাদাত-আমল বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। ৩) মুমিন মাত্রই যাবতীয় যুলূম বা পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। রজব মাস যেহেতু একটি সম্মানিত মাস, সেহেতু এ মাসের সম্মানে যাবতীয় পাপাচার থেকে আত্মরক্ষায় সর্বোচ্চ গরুত্ব প্রদান করা তাক্বওয়ার দাবী। ৪) সালাফগণ বলতেন- রজব মাস ইবাদতের যমীনে বীজ বপনের মাস, ‘শা’বান’ বপিত বীজ/গাছে পানি সিঞ্চনের মাস, আর রমযান হলো- ফল আহরণের মাস। সুতরাং এই সম্মানিত মাসে- ক) জামাতের সহিত ফরয সালাত আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করা উচিৎ। খ) সাপ্তাহিক (সোম ও বৃহস্পতিবার) নফল সিয়াম এবং মাসিক (চন্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫) আইয়্যামে বীয-এর সিয়াম পালনে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করা।যদিও ফযীলতপূর্ণ এ সিয়াম প্রত্যেক মাসেই রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। গ) শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) অধিকহারে সিয়াম পালন করতেন। তাই শা’বানে বেশি বেশি সিয়াম পালনের সংকল্প করা। এতে সিয়ামের ফযীলত অর্জনের পাশাপাশি রমযানের সিয়াম পালন সহজতর হয়ে উঠে। ঘ) রমযানের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
উল্লেখ্য যে, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’ দু’আটি রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়তেন মর্মে বর্ণিত হাদীসটি দুর্বল। তাই এটি পাঠ সুন্নাত বলা ঠিক নয়। তবে দু’আটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে নিসবত তথা সম্বন্ধিত না করে সাধারণ দু’আ হিসেবে নিজ থেকে পাঠ করাতে কোন অসুবিধা নেই। (আল্লাহু আ’লাম)
আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে বিদআত পরিহার করে- বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত সুন্নাহর যথাযথ অনুসরণ করার তাওফীক্ব দান করুন।
লেখক : খতীব, মনির উদ্দিন ভূঁঞা দারোগা বাড়ী জামে মসজিদ, ১০নং ওয়ার্ড, ফেনী।