বৃদ্ধ ও আশ্রম শব্দ দু’টি মিলে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। শব্দগতভাবে অর্থ দাঁড়ায় বৃদ্ধনিবাস বা বৃদ্ধের আশ্রয়স্থল। অন্য অর্থে জীবনের শেষ সময়ের আবাসস্থল, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে বৃদ্ধাবস্থায় পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয় ব্যতীত সরকারী-বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় লালিত-পালিত হওয়ার স্থানকে বৃদ্ধাশ্রম বলে।এই বৃদ্ধাশ্রম নামটি শুনলেই চোখের সামনে ধরা দেয় ক্রন্দনরত মায়ের মুখ, ম্রীয়মান বাবার দুর্বল চাহনি। এ যেন জীবনের পরম অভিশাপ। সারাজীবন নিজের ছেলে মেয়েদের বড় করে তুলে শেষ জীবনে সন্তানকে অবলম্বন করে বাঁচার চেষ্টা যেন অন্যায়। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি আমাদের দেশে এখনও মহামারী হিসেবে ধরা না দিলেও দিন দিন এর আকার বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অসাধারণ এক গানে জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতা যেন পুরো বিষয়টিকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এক অদ্ভুত সৃষ্টিতে।”ছেলে আমার মস্ত মানুষ,মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার ।/নানান রকম জিনিস, আর আসবাব দামী দামী/সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।/ ছেলের আমার,আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!”
ইতিহাস থেকে জানা যায় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনের শান রাজবংশে। মূলত গৃহহারা অসহায় বৃদ্ধ নারী, পুরুষের জন্য খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে শান বংশ এই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করেছিল এবং এজন্য তারা ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে । যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করার সুব্যবস্থা ছিল। ইতিহাসবিদেরা এই বৃদ্ধাশ্রমকে সভ্যতার অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবহিত করেছেন। বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তন হয় ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের হাত ধরে। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে। এই সকল সংস্থা মূলত বৃদ্ধ বয়সে যাদের সহায় সম্বল নেই, তাদেরকে মাথায় রেখেই কাজ পরিচালনা করে।এছাড়াও সারাদেশে নিবন্ধনহীন আরও অনেক বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। দুই দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
কালের বিবর্তনে বৃদ্ধাশ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে আজ ভিন্নার্থে। বর্তমান প্রেক্ষাপট লক্ষ করলে দেখা যায়, বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশী আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে তাদের মানুষ করেছেন, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা-বাবা ব্যাকুল থাকতেন, সে না খেলে যিনি থাকতেন অনাহারে, না ঘুমালে থাকতেন নির্ঘুম, অসুস্থ হ’লে ঠায় বসে থাকতেন শিয়রে, যে বাবা-মা তিল তিল করে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য, যে বাবা নিজের পকেট খরচকে বাঁচিয়ে রাখতেন তার সন্তানের টিউশন ফী অথবা টিফিনের টাকার জন্য, যারা নিজের অসুস্থতার কথা না ভেবে কেবল তার সন্তানদের কথা চিন্তা করে প্রত্যুষেই নেমে পড়তেন রূযীর সন্ধানে, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। যে যৌবনকাল ছিল চঞ্চলতায় ভরপুর, যে যৌবনকালের কর্মস্পৃহার বদৌলতে গড়ে উঠল এই সৌন্দর্যময় আবাসস্থল, বিস্তার লাভ করল শিক্ষা, উৎকর্ষ সাধিত হ’ল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, সে যৌবনের উচ্ছলতা আজ হারিয়ে গেছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তারা নিজেরাই আজ অচল, জরাজীর্ণ বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে চরম অসহায়ত্ব বরণ করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৃদ্ধাশ্রম নামীয় কারাগারে স্থান পেয়েছে। একসময় যারা নামী দামী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও
চাকরিজীবী ছিলেন, বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারাই। পরিবার ও সন্তান থেকেও যেন ‘সন্তানহারা ইয়াতীম’ হয়ে জীবন যাপন করছেন।
এখন প্রশ্ন হল কেন এই পচনক্রিয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুরু হয়েছে। সন্তানকে পালন করতে আমাদের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পাশ্চত্য সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করতে আমরা নিজেদের ঘরকে হারিয়ে ফেলছি। ধন, প্রাণ নিঃশেষ করে একজন বাবা, মা সন্তানকে পালন করেছেন। সেই সন্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর বাবা-মাকে ভুলে যাচ্ছে। আমাদের বহুমুখী কর্মব্যস্ততায় পারস্পরিক দায়বদ্ধতা লোপ পাচ্ছে, আর মা-বাবা তথা প্রিয়জনের প্রতি বাড়ছে উপেক্ষা।তাদেরকে ভাবছি পরিবারের বোঝাস্বরপ। এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকেই আমরা তাদেরকে জোর করে পাঠিয়ে দেই বৃদ্ধাশ্রমে। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের ছেলে-মেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার। আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ আল্লাহতায়ালার নির্দেশ “তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন : তোমরা কারও ইবাদত কর না, একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর। পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদের ‘উহ’ পর্যন্তও বলো না এবং তাদের ধমকের সুরে জবাব দিও না বরং তাদের সঙ্গে মর্যাদাসহকারে কথা বল। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাক এবং দোয়া করতে থাক এই বলে : হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতাসহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে বোঝা/ দায় মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদের ফেলে রেখেছি, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আজ তারা বৃদ্ধ, কাল আমরাও সেই পথ বেয়ে হেঁটে যাব। বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে কেউ আসে না। তাঁরা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না। বরং আমরা সন্তানরাই তো তাদের‘বোঝ্#া৩৯; ছিলাম। তারা তো কখনো আমাদেরকে বোঝা মনে করেননি। আমাদেরকে বড় করে তোলার জন্য তাঁরা বিন্দু পরিমাণ কমতি করেননি।
মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা ভয়াবহ অন্যায়, নৈতিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়েও অগ্রহণযোগ্য ।তাই এখনই সময় এ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন সুনিশ্চিত করা। সবার মনে রাখা উচিত, দীর্ঘ জীবন পেলে বার্ধক্যের স্বাদ আমাদের সবাইকে পেতে হবে, এটাই জীবনের ধর্ম। তাই বৃদ্ধ বয়সে নিজের সন্তানের মতোই বাবা-মাকে আরেক সন্তান মনে করে, অবহেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে না দিয়ে, তাদের সেভাবেই সেবা-যত্ন দিয়ে তাদের বাকি জীবনকে যতটুকু সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা যায়, তা করে যেতে হবে। এই উদ্দেশ্যে যেমন কঠোর আইন করা দরকার, তেমনি দরকার নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা।
মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসার, সামাজিক অনুশাসনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। কোনো মা-বাবাকে যেন অবহেলা আর অনাদরে জীবনযাপন করতে না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ, প্রচারমাধ্যম সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, জন্ম হতে মৃত্যু পযর্ন্ত পরিবারই হোক আমাদের সবার একমাত্র ঠিকানা, পরিবারই হোক মা-বাবার বৃদ্ধাশ্রম।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।