রাশেদুল হাসান
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত ফেনী। জেলার সব উপজেলায় বন্যার পানি উঠলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও সদরে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি ছিল জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা ও বিভিন্ন বিপণীবিতান, উঁচু ভবনে অবস্থান করেন দুর্গতরা। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। খাবার, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে।
ফেনীতে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছালেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনো বহু এলাকায় খাবার-পানি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বন্যায় ভেঙে গেছে রাস্তা-ঘাট। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও পুকুরের মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেললাইন। ২০ আগস্ট বন্যা শুরুর পর থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা নিরলসভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম করছেন। সারাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, নৌকা, স্পিডবোট, খাবার, পানি নিয়ে ছুটে এসেছেন।
এবারের বন্যা এতোটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে। ত্রিপুরাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বোরক টাইমস ও ত্রিপুরা টাইমসের খবরে বলা হয়, ২১ আগস্ট বুধবার প্রায় ৩১ বছর পর ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষ ডুম্বুর জলাধারের বাঁধের স্লুইস গেট খুলে দিয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে এ বাঁধের স্লুইস গেট খোলা হয়েছিলো। ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ২৬ আগস্ট ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এতে একদিনে বাংলাদেশে ঢুকবে ১১ লাখ কিউসেক পানি। বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদসহ বাংলাদেশেও।
এভাবে উজানের দেশ ভারত যদি একটার পর একটা বাঁধের গেট খুলে দেয় তাহলে এদেশের মানুষের কী অবস্থা হবে। লাখ লাখ কিউসেক পানি ছোট্ট এ দেশে প্রবেশ করলে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে আন্দাজ করা যায়। মাত্র দুদিনে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় ফেনীসহ আশপাশের জেলার ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই গেল সেটাতো সবাই টের পেয়েছেন।
প্রতি বছর দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ১৯৬৬ সালের বন্যায় ৩৯ জনা মারা যায়। প্রায় ১২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮৭ সালের বন্যায় দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখ লাখ মানুষ। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। স্থানভেদে বন্যাটি ১৫-২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ১৯৯৮ সালের বন্যায় দুই মাসের বেশি সময়জুড়ে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০০০ সালের বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলায় ব্যাপক ক্ষতি করে। প্রায় ৩০ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের বন্যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ও ২০২২ সালের বন্যায় সিলেটে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসময় ওই বিভাগের ৮০ শতাংশ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেন।
১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যাকে ফেনীর মানুষ ভয়ঙ্কর বলে মনে করে। সেটিকেও অতিক্রম করেছে এবারের বন্যা। বন্যায় স্থানভেদে ২০ ফুটের বেশি পানি উঠেছে। প্রবল স্রোতে ঘরবাড়ি, গবাদি পশু ভেসে গেছে। এ বন্যায় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার ৬৫ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৪৫ লাখ মানুষ। শুধুমাত্র ফেনীতে ১০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জেলায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এখনো সে তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে, তথ্য সংগ্রহ চলছে।
বন্যাকবলিত ফেনীতে গত ২৪ আগস্ট থেকে দুদিন অবস্থান করি। শহরসহ সদরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। সেখানকার মানুষের ভাষ্য- জীবনে এতো পানি দেখিনি। এবারের বন্যা সব কেড়ে নিয়েছে। আগের বন্যায় দুর্ভোগ থাকলেও এবার সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ ভোগান্তি কতদিন থাকবে সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
সাধারণত জুন-সেপ্টেম্বর মাসে এদেশে বন্যা হয়। সে প্রস্তুতি থাকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের। এবারও কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার বিষয়ে পূর্ব সতর্কতা ছিল। তবে যে মাত্রায় বন্যা হচ্ছে সে বিষয়ে প্রাথমিক সমীক্ষা ছিল না। কিন্তু কেন? আকস্মিক বন্যায় অনেক অনিশ্চয়তা থাকে সেটাতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বোঝার কথা। তারপরও কোনো ধরনের দৃশ্যমান প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি কেন? বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে- অন্তত তিনদিন আগে থেকেই ওয়ার্নিং ছিল। একদিন আগে ডেঞ্জার লেভেলের ফোরকাস্ট দেওয়া ছিল, যে ডেঞ্জার লেভেল ক্রস করবে। কিন্তু এ অল্প সময়ে কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না এ শিক্ষাটা অন্তত পেলাম। এসব ক্ষেত্রে সবাইকে আরও আন্তরিক ও সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক।