দৃশ্যপট : এক- বই : রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালোচোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়। রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেন্’া প্রবন্ধে বই কিনতে বাঙালীর উদাসীন আচরণের দিকে দৃষ্টিপাত করে কটাক্ষ উক্তিটি করেছেন। লেখক বইকেনা প্রবন্ধে বই বিমুখ বাঙালীর উদাসীন আচরণের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
বই অনন্ত যৌবনা। বইয়ের মলাট পুরনো কিংবা বিবর্ণ হতে পারে কিন্তু এর থেকে রস্বাসাধন অমৃতসম। বই কাঁদায়, হাসায়, বই মেধা মননকে শানিত করে। ভ্রমণ পিপাসু মনকে উদ্দীপ্ত করতে পারে ভ্রমণ বিষয়ক বই। বই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বই চিন্তার খোরাক জোগায়। বই জীবন থেকে জীবনে পরিবর্তনের রেখাপাত সূচিত করে। বই পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের উন্মোচন ঘটায় এবং এর ক্রমবিকাশে আলোর দিশারী হয়ে রয়। মানুষের সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, ইহজাগতিক, পরজাগতিক, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সকল প্রকার মানষ ও এর নীতিবিধির পরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্বাক্ষ্য বহন করে, বই।
মানুষের যৌবনের আনন্দ আয়োজন, আড্ডা, হাস্যরস, কথা কৌতুক সকল কিছু বয়সের মধ্যরেখার সাথে সম্পর্ক যুক্ত। বয়স হারিয়ে যায়। বড় হতে হতে মানুষ বুড়িয়ে যায়। বয়সের উচ্ছ্বাস উন্মাতাল হল্লা ততক্ষণ, যতক্ষণ যৌবনের রস সঞ্জীবনী পূর্তির খোরাক যোগায়। কিন্তু বয়স যখন পড়ে যেতে থাকে একে একে প্রিয়জন সব দুরে সরে যেতে থাকে। এক সময় আড্ডাতো দুরে থাক সম্যক সময় দিয়ে কথা বলবারও কেউ থাকেনা। রঙীন আলোর জলসা নাই, রূপসী রঙ্গিলা প্রেয়সী নাই। নিঃসঙ্গ বোবা জীবনের উত্তম বন্ধু হতে পারে বই, বই এবং বই। হ্যাঁ যদি তেমন বই হয়।
যে বই জীবনকে আন্দোলিত করতে পারে। যে বই যৌবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যৌবন এমন এক জিনিস, যা মন চায় তাই সে করতে পারে। যৌবন, ইচ্ছের স্বাধীণতায় অমৃত সন্ধানে উন্মুখ হতে পারে। সুপ্ত মননে চিন্তার বিকাশ ঘটায় বই। মনের যা কিছু চাওয়া-পাওয়া তার পূর্ণতায় বই অকৃত্রিম বন্ধুর মত। আবার মনের অশুদ্ধ ইচ্ছা-আকাংখা দমিত করতে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। সে বই অনন্ত যৌবনা। সে বই-ই প্রিয় বন্ধুসম।
দৃশ্যপট : দুই- যৌবন বন্ধনা : কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছ্য়িঁড়ঃ; কবিতার শুরুতেই কবি যৌবন বন্দনা করে বলেছেন-
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবর তার শ্রেষ্ঠ সময়:
একটি জাতির ভাষার দাবী নিয়ে কবির এই আকুতি। যে যৌবন দেশ মাতৃকার ভালোবাসায় জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যে যৌবন দুঃখি মানুষের দাবি আদায়ে যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে মৃত্যু ভয় তোয়াক্কা করেনা, সে-ই উত্তম যৌবন। যৌবনের অবগাহন শুধু বন্ধুত্ব, আনন্দ আয়োজন, হৈ হুল্লোড়, নেতৃত্ব, মিছিল, মিটিং, আন্দোলন সংগ্রাম নয়। যৌবনকে জীবনের শুদ্ধ অমৃতরসে সাজিয়ে নিতে যৌবনকে যে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হয় তার নাম আত্মসংযম। এ দাবি যে বা যারা পূরণ করতে পারেন তারাই খাঁটি সোনার মানুষ হয়ে উঠতে পারেন। আর যারা সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহে যৌবনকে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার অমানিশা। তারা শুধু নিজেরাই বিপদগামী হয় তা নয়, তারা পরিবার তথা সমাজের মানুষের জীবনেকেও বিষাদময় করে তোলে।
যৌবন নারী-পুরুষ সবার জীবনেই উচ্ছ্বাস নিয়ে আনে। যারা যৌবনকে সততা, ন্যায় নিষ্ঠতা, নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা, পরোপকারীতা, উদার অহিংস মনোবৃত্তি, ধর্মীয় নীতিবিধি ও সুশৃঙ্খল জীবনের ঘূর্ণাবর্তে রাঙিয়ে নিতে পারে বা অনুশীলনের চেষ্টায় সচেষ্ট থাকতে পারে তারাই আলোকিত জীবন লাভ করে থাকেন। এই পার্থিব জীবন ক্ষণ¯’ায়ী। যে কোন সময় মৃত্যুর দূত ইহজাগতিক মায়ালোকের বন্ধন ছিন্ন করে অসীম অনন্ত লোকের যাত্রায় ডেকে নিতে পারে। সেই অনন্ত লোক তথা পরকালীন সুখের সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য এই পার্থিব যৌবনকে সাজাতে হবে স্রষ্টার চাওয়া পাওয়া তথা বিধিনিষেধের মধ্য থেকে।
জীবনে প্রবেশের নির্বাচিত সূচিপত্র থাকলেও জীবন থেকে প্রস্থানের কোন সূচিপত্র নাই। বাবা, মা কিংবা নানী,দাদীর আগে অতি আদরের নাতি নাতনীকে চলে যেতে হয় মৃত্যুর ওপারে। সকল ধর্মেই (যারা ধর্ম বিশ্বাস করে) ইহকালীন কর্মের দ্ধারা পরকালীন কল্যাণ অকল্যাণ, স্বর্গ, নরক উভয় প্রাপ্তীর কথা বলা হয়েছে। পরকালীন কল্যাণ লাভের কর্ম¯’ল এই মায়াবী দুনিয়া। যৌবনের রঙ্গমঞ্চ মায়াবী দুনিয়ার অন্যতম স্টেশন। এই স্টেশন থেকে কে কোন পথের যাত্রী হবে তা তাকেই নির্ণয় করে নিতে হবে।
দৃশ্যপট: তিন- যৌবন ও আধ্যাত্মিকতা : বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থগুলোতে যৌবনের উচ্চকিত প্রশংসা করা হয়েছে। শুধু প্রশংসা করা হয়েছে তাই নয়, অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সংযমী জীবন যাপনের বিষয়েও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কবর, হাশর, মিজান সর্বোপরি দোজখের কঠিন শাস্তির বিষয়ে শতর্কারোপ করা হয়েছে। আল্লাহতালা কোরানুল কারিমে বলেছেন- আমি মানুষকে (সামান্যতম) নাপাক বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি।
অন্ধকার মাতৃগর্ভে মায়ের শরীরে প্রবাহমান রক্তের নহর যুক্ত করে বিন্দু বিন্দু করে মানবের অস্তিত্ব দান করেন। সেই মানব শিশুর জন্য মাতৃ স্তন্যে দুধের নহর প্রবাহিত করে দেন। অতঃপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে সেই মানব শিশু শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে úূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে।
যৌবনকাল মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামত। এ সময় মানুষের ইবাদতের শক্তি ও সুস্থতা দুটিই থাকে। এ সময়ে একজন মানুষ যতটা শুদ্ধতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে আমল করতে পারে, বৃদ্ধ হয়ে গেলে তা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাই এই মহামূল্যবান নিয়ামত কোনোভাবেই হেলাফেলায় পার করা উচিত নয়।
যুবকদের উদ্দেশ্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘একজন বৃদ্ধের ইবাদতের চেয়ে আল্লাহ বেশি খুশি হন যেসব তরুণ-তরুণী যৌবন বয়সে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে।’
প্রিয়নবী আরো বলেন, ‘কেয়ামতের দিন ৫টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ব্যতীত মানুষকে এক কদম নড়তে দেয়া হবে না; তার মধ্যে একটি হলো- ‘সে তার যৌবনকাল কোন পথে ব্যয় করেছে।’
অন্য হাদিসে তিনি ৫টি অবস্থার পূর্বে ৫টি অবস্থাকে মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন, তন্মধ্যে একটি হলো- ‘তোমরা বার্ধক্যের আগে যৌবনকে মর্যাদা দাও।’
হাশরের ময়দানে ৭ শ্রেণির মানুষকে আল্লাহতালা তাঁর আরশের ছায়াতলে স্থান দিয়ে সম্মানিত করবেন। সেই মর্যাদাবান মানুষদের দ্বিতীয় সম্মানিত মানুষ হবেন তারা, যারা যুবক বয়সে যৌবনকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন করেছে, তারা যুবক।
যুবক বয়সের অধিকাংশ নারী-পুরুষই দুনিয়া অর্জন তথা ধন-সম্পদ, বাড়ী-গাড়ী ও চাকচিক্যময় জীবন-যাপন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পরকালের কথ বেমালুম ভুলে থাকে। আল্লাহর বিধান ও পরকালের সীমাহীন জীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে থাকে না।
একান্তই যারা যৌবনে ইবাদত-বন্দেগি ত্যাগ করে বিপথে জড়িয়ে গেছে, তাদের জন্যও আল্লাহতাআ-লার রহমতের দরজা খোলা। তাদেরকে নিরাশ না হতে কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন- (হে রাসূল!) আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা যুমার : আয়াত ৫৩)
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণকে নবুয়ত ও রেসালাতের দায়িত্ব টগবগে যুবক বয়সেই প্রদান করেছিলেন।
এ কারণেই হজরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যুবক ছাড়া যেমন কোনো নবী পাঠাননি, তেমনি যুবক ছাড়া কাউকে ইলমও দান করেননি।’
হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ বলেন, ‘যৌবনের ইবাদত বৃদ্ধ বয়সের চেয়ে অনেক বেশি দামী। আবার বৃদ্ধ বয়সের পাপ যৌবনের পাপের চেয়ে অনেক বেশি জঘন্য।’
শেখ সাদী রঃ বলেছেন, ‘দুনিয়া ও পরকালের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা এ যৌবন কালেই সংগ্রহ কর।’ তাই যৌবনের গঠন এমন হওয়া উচিত, বান্দা তার যৌবনকে পাপমুক্ত রেখে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবে। সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, হিংসা, হানাহানি, যেনা-ব্যাভিচারসহ সকল প্রকারের গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হবে। আল্লাহকে ভয় করবে। মানুষের উপকারার্থে নিয়োজিত হবে। সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানে সচেষ্ট হবে। তাহলেই যৌবন হবে স্রষ্টার রঙে রঙীন ও নিখাঁদ প্রেমময়।
লেখক : চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।