দৈনিক ফেনীর সময়

শয়তানের মিশন

শয়তানের মিশন

১। সূরা বাকারার ১৬৮নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; সে নি:সন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ২। সূরা বাকারার ২০৮নং আয়াতে বলা হয়েছে- হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ৩। সূরা আনয়ামের ১৪২নং আয়াতে রয়েছে- আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তা থেকে খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। অবশ্যই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ৪। সূরা আ’রাফের ২২নং আয়াতে রয়েছে- আর তাদের (হযরত আদম ও হাওয়ার) প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? ৫। সূরা ইউসূফের ৫নং আয়াতে রয়েছে- নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ৬। সূরা ইসরার ৫৩নং আয়াতে রয়েছে- নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ৭। সূরা ফাতিরের ৬নং বলা হয়েছে- শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। ৮। সূরা যুখরুফের ৬২নং আয়াতে বলা হয়েছে- শয়তান যেন তোমাদেরকে নিবৃত্ত না করে। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

শয়তানের মিশন : আল্লাহ তা’য়ালার অবাধ্য, অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার পর শয়তান একটি মিশন নিয়ে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয়ী হয় এবং সে স্বীয় মিশন পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ তা’য়ালার নিকট সময় ও সুযোগ প্রার্থনা করে। আল্লাহ তা’য়ালা মানবজাতিকে পরীক্ষা করার জন্য তার প্রার্থনা কবুল করেন। আল্লাহ তা’য়ালার বাণী- শয়তান বললো, আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সুযোগ দিন, আল্লাহ তা’য়ালা বললেন- তুমি সুযোগ প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত (আরাফ- ১৫)। আর শয়তান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার মিশন বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চালায়।

প্ররোচনা দান : শয়তান হযরত আদম ও হাওয়া (আ) কে প্ররোচনা, ধোঁকা ও প্রলোভন দেখিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে প্রতারিত করে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- অত:পর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল- আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী (সূরা আরাফ (২১-২১)। আরো ইরশাদ করেন- অত:পর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল, বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা? (সূরা ত্বাহা- ১২০)।

পথভ্রষ্ট করা : শয়তানের স্বঘোষিত মিশন হলো মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রবঞ্চনা দ্বারা পথভ্রষ্ট করা এবং আল্লাহর অবাধ্যতায় তার অনুসারী বানানো। শয়তান আল্লাহ তা’য়ালাকে বলেছে- আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবো, বৃথা আশ্বাস দেব, তাদেরকে নির্দেশ দেব যার ফলে তারা পশুর কর্ণচ্ছেদ করবে এবং তাদেরকে নির্দেশ দেব যার ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে (সূরা নিসা- ১১৯)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন- আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায় (সূরা নিসা- ৬০)। শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়ে আল্লাহকে বলছে- আপনার সম্মানের শপথ! আদম সন্তানের সাথে রূহ থাকা পর্যন্ত আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবো না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- আমার ইজ্জতের শপথ! আমি তাওবা দ্বারা আদম সন্তানকে আড়াল করবো, যতক্ষণ আত্মা গড়গড় শব্দ না করে (ইবন জারীর-৪/২০৪)।

ধোঁকা দেয়া : ধোঁকা দেয়া শয়তানের অন্যতম কৌশল। শয়তান হযরত আদম ও হাওয়া (আ) কে ধোঁকা দিয়ে বললো- মানুষের পরিণাম হলো মৃত্যু, তবে এ বৃক্ষের ফল যে খাবে সে চিরজীবী হবে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- অত:পর শেষ পর্যন্ত শয়তান এ ব্যাপারে তাদের পদস্খলন ঘটালো এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার প্ররোচনা দ্বারা বহিস্কৃত করলো। (সূরা বাকারা- ৩৬)।

মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ : শয়তান আল্লাহ তা’য়ালার সাথে এ চ্যালেঞ্জ দিয়েই নেমেছে যে, সে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ছাড়বে। অত:পর সে কুপ্ররোচনার মাধ্যমে মানুষের সামনে অশ্লীল ও খারাপ জিনিসকে আকর্ষনীয় ও উত্তম হিসেবে পেশ করে। হালালকে হারাম, হারামকে হালাল, দ্বীনের বাইরের কথাকে দ্বীনের কথা বলে চালিয়ে দেয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- অবশ্যই সে (শয়তান) তোমাদেরকে খারাপ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেবে। আর যেন আল্লাহর উপর এমন কথা বলো যা তোমরা জানো না (সূরা বাকারা- ১৬৯)।

নিজেদের দলভূক্ত করার প্রচেষ্টা : শয়তান মানুষদের বশীভূত করে নিজেদের দলভূক্ত করে নেয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে, অত:পর আল্লাহর স্মরণ ভূলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।

সরল পথে বসে থাকা : শয়তান মু’মিনদের পথভ্রষ্ট করার জন্য সদা সচেষ্ট। এ লক্ষ্যে সে সিরাতুল মুস্তাকিমে বসে থাকে যাতে কেউ এ পথে আসতে না পারে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- শয়তান বললো, আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। অত:পর তাদের কাছে আসবো তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বামদিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। (সূরা আরাফ – ১৬-১৭)।

মানবের শিরায় উপশিরায় বিচরণ : শয়তান আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা লাভ করে আদম সন্তানের শিরায়-উপশিরায় বিচরণ ও চলাফেরা করে আদম সন্তানকে পথহারা করে। মহানবী (স) বলেছেন- অবশ্যই শয়তান মানুষের শিরায়-উপশিরায় বিচরণ করে। (বুখারী হাদীস নং- ১২৮৮, মুসলিম হাদীস নং- ২১৭৪)।

সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করা : মানুষকে পথভ্রষ্ট করার শয়তানের অন্যতম কৌশল হলো সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করা। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দয্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব। আপনার মনোনীত বান্দাগণ ব্যতীত (তাদের কোন ক্ষতি আমি করতে পারবো না) সূরা হিজর- ৩৯-৪০)। আল্লাহ তা’য়ালা শয়তানকে বলেন- অবশ্যই যারা আমার বান্দাহ, তাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই, কিন্তু পথভ্রষ্টদের মধ্য থেকে যারা তোমার পথে চলে, তাদের সবার নির্ধারিত স্থান হলো জাহান্নাম (সূরা হিজর- ৪৩-৪৪)।

ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা : শয়তান মু’মিনের ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইবাদত নষ্ট করে দেয়, যাতে তাকে সে পূণ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। হযরত ওসমান ইবনে আবুল আস (রা) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন- আমি একদা রাসূল (স) এর নিকট আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (স)! শয়তান আমার মাঝে এবং আমার নামায ও কিরাতের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতে জটিলতা সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহ (স) তখন বললেন, তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে, তখন তার কুমন্ত্রণা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বামদিকে তিনবার থু থু ফেলবে। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল (স) এর কথা অনুযায়ী আমি অনুরূপ করলাম। ফলে আল্লাহ তা’য়ালা আমার নিকট হতে শয়তানকে দূর করে দেন (মুসলিম)।

প্রভাব বিস্তার করা : শয়তান আদম সন্তানের উপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করে। এতে সে নানাভাবে প্রভাবিত করে। রাসূল (স) ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই আদম সন্তানের ওপর শয়তানের একটি প্রভাব রয়েছে। অনুরূপ ফেরেশতারও একটি প্রভাব রয়েছে। শয়তানের প্রভাব হলো, অকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। আর ফেরেশতার প্রভাব হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং সত্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে সে যেন জেনে রাখে, এটা আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকেই হয়েছে। কাজেই তার উচিত আল্লাহ তা’য়ালার প্রশংসা করা। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে, সে যেন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহ তা’য়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। অত:পর রাসূলুল্লাহ (স) এ আয়াতটি পাঠ করলেন, “শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার প্রতি নির্দেশ দেয়” (তিরমিযী)।

কুমন্ত্রণা দেয়া : শয়তান মু’মিনকে কুমন্ত্রণা দেয়। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- তোমাদের কারো নিকট শয়তান এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছেন? ওটা কে সৃষ্টি করেছেন? এমনকি সে এরূপ প্রশ্নও করে থাকে যে, তোমার প্রভুকে কে সৃষ্টি করেছেন? সুতরাং শয়তান যখন এ পর্যায়ে পৌঁছে তখন ঐ ব্যক্তির উচিত আল্লাহ তা’য়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং (শয়তানের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া থেকে) বিরত থাকা (বুখারী ও মুসলিম)।
বলা বাহুল্য যে, সকলের সাথে শয়তান আছে। সকল মানুষের সাথে শয়তান আছে। মহানবী (স) বলেন- তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সাথে জিন এবং ফেরেশতাদের মধ্য হতে কাউকে সঙ্গী নিযুক্ত করা হয়নি। সাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! আপনার সাথেও কি জিন সঙ্গী নিযুক্ত আছে? রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, হ্যাঁ, আমার সাথেও আছে। তবে আল্লাহ তা’য়ালা তার ওপর আমাকে গালেব করেছেন, ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। সে আমাকে কল্যাণকর কাজ ব্যতীত অন্য কোন কাজের পরামর্শ দেয় না (মুসলিম)। মহানবী (স) বলেছেন- তোমরা বাম হাতে খেয়ো না, কারণ শয়তান বাম হাতে খায় (মুসলিম ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ১৯৮)।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!