fenirshomoy logo black

খন্দকার নাজমুল হক :

আজ ১৪ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তন। সমাবর্তনে প্রায় ২২ হাজার ৫৬০ জন গ্র্যাজুয়েট সমাবর্তনে অংশ গ্রহণ করবেন। এ অনুষ্ঠানে প্রায় ১৪ কোটি টাকা খরচ হবে। সমাবর্তনকে ঘিরে চবিতে সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে তাঁকে ডি-লিট ডিগ্রি দেয়া হবে। সমাবর্তনে প্রধান বক্তা থাকবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সভাপতিত্ব করবেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। এবার সমাবর্তনে অংশ নেবে ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যেসব শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তারা। সমাবর্তনটি হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন, ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়, ২০০৮ সালে তৃতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

২০১৬ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সমাবর্তনে প্রায় ১৫,০০০ গ্যাজুয়েট অংশগ্রহণ করতে পারে নাই, সেজন্য ২০২৬ সালে একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান করে বাদপড়া গ্যাজুয়েটদের সুযোগ দেওয়ার জন্য ভিসি মহোদয়কে অনুরোধ করেছেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন এর সভাপতি সাবেক চাকসু ভিপি এস.এম. ফজলুল হক, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকীর এবং সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের ভিপি মো: রেজাউল করিম। ১৪মে বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে সমাবর্তন শোভাযাত্রা হবে। তবে এতে কোনো গ্র্যাজুয়েট অংশ নিতে পারবেন না। পরে বেলা দুইটায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, ডি-লিট গ্রহণ, শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য, উপাচার্যের বক্তব্য, দুই সহ-উপাচার্যের বক্তব্য মিলিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হবে বিকেল চারটায়। অংশগ্রহণকারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রায় ১০০টি বাস চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। সমাবর্তনের দিন ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি প্রবেশ করবে না। ব্যক্তিগত গাড়ি ১ নম্বর গেট এলাকা পর্যন্ত আসতে পারবে। সেখান থেকে শাটল বাসে করে অংশগ্রহণকারীদের ক্যাম্পাসে আসতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য শহীদ মিনার, জারুল তলা, সায়েন্স ফ্যাকাল্টিসহ পাঁচটি পয়েন্টে এলইডি স্ক্রিনে অনুষ্ঠান দেখানো হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনেও (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করা হবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সমাবর্তনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন সমাবর্তন আয়োজন কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক এনায়েত উল্যা পাটোওয়ারি, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ তালুকদার, তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার প্রশাসক সহযোগী অধ্যাপক মো. শহীদুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫ম সমাবর্তন সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অংশগ্রহণকারী গ্র্যাজুয়েট ও অতিথিদের মানতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) দেওয়া বিশেষ নির্দেশনা।

সমাবর্তনের বিশেষ নির্দেশনা ১) সমাবর্তনের দিন সকাল ৬টা থেকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ১০০টি নির্ধারিত বাস চলবে। শুধু গ্র্যাজুয়েটরা এসব বাসে উঠতে পারবেন। অনুষ্ঠান শেষে বাসগুলো তাদের শহরে ফিরিয়ে দেবে। পাশাপাশি চলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনও। ২) দুপুর ১টার পর কাউকে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে দেবে না এসএসএফ। লাইনে থাকলেও ১টা বাজলে আর প্রবেশ করা যাবে না। ৩) দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ বের হতে পারবেন না। ৪) মোবাইল ফোন ছাড়া অন্য কিছু সঙ্গে নেওয়া যাবে না। বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের না আনার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন। ৫) ১ নম্বর গেটের ভেতরে ব্যক্তিগত গাড়ি ঢুকতে পারবে না। অংশগ্রহণকারীরা ড্রাইভারসহ গাড়ি আনলে গেটে নামিয়ে দিয়ে নির্ধারিত শাটল বাসে অনুষ্ঠানস্থলে যেতে হবে। ৬) সমাবর্তন বক্তা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রুটে থাকা হোটেলগুলো দুপুর ১২টায় বন্ধ থাকবে। তবে অনুষদের ক্যান্টিনগুলো খোলা থাকবে এবং অতিথিদের বসার ব্যবস্থাও থাকবে। ৭) ১২ ও ১৩ মে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা এবং ১৪ মে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে নিজ নিজ বিভাগ থেকে গাউন, টুপি ও প্রবেশ কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। প্রবেশ কার্ড ছাড়া কেউ অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে পারবে না। ৮) ১৪ তারিখ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে নিজ বিভাগ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হবে। অনুষ্ঠান শেষে গাউন জমা দিয়ে সার্টিফিকেট ও উপহারসামগ্রী নেওয়া যাবে। ৯) অনুষ্ঠান শেষে গাউন ও হুড ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের অফিসে সকাল ৯:০০টা থেকে বিকেল ৩:৩০টার মধ্যে বুঝিয়ে দিতে হবে।

১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হাটহাজারী উপজেলার ফতেপূর ইউনিয়নে ২৩১২ একর জমিতে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস এবং অর্থনীতি বিভাগ ২০০জন ছাত্রছাত্রী, ৭জন শিক্ষক নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বীর চট্রলার কৃতিসন্তান পাকিস্তানের স্পীকার ও প্রেসিডেন্ট (ভারপ্রাপ্ত) ফজলুল কাদের চৌধুরী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরে আমরা গৌরববোধ করছি। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুস আজ বাংলাদেশের কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ড. ইউনুস বিশ্ববাসীর নিকট বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক । তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত সামাজিক ব্যবসা হিসেবে সুপরিচিত তিন শুন্য মডেল নিয়ে কাজ করছেন। ইউরোপ আমেরিকা মহাদেশে বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে ড. ইউনুসের দেশের লোক বলা হয়ে থাকে। প্রফেসর ড. ইউনুস কে ফাদার অব মাইক্রো ক্রেডিট বলা হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. এ আর মল্লিক (সাবেক অর্থমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)। শিক্ষক সংখ্যা ৯০৭ জন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১১৫২জন। মোট ছাত্রছাত্রী ২৭,৫৫০ জন। ৯টি অনুষদের অধীনে ৫২টি বিভাগ, ৬টি ইন্সটিটিউট, ৫টি গবেষনা কেন্দ্র আছে। আবাসিক হল ১২টি, ছাত্রদের ৮টি এবং ছাত্রীদের ৪টি হল, প্রায় ৭,৫০০ ছাত্র ছাত্রী আবাসিক হলে থাকার সুব্যবস্থা আছে। অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২১ টি। ইতিহাস বিভাগের ৩ (তিন) জন প্রফেসর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এর দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. এ আর মল্লিক, প্রফেসর ড. আব্দল করিম ( একুশে পদক প্রাপ্ত ) এবং প্রফেসর ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন ( একুশে পদক প্রাপ্ত এবং জাতীয় অধ্যাপক)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য গুনিজন: প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুস (শান্তিতে নোবেল বিজয়ী), প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. অনুপম সেন, প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদি, প্রফেসর ড. ফজলে হোসেন, প্রফেসর আ. ক. ম আব্দুল কাদের, প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ আল মাসুম, প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান, ফজলে কবীর (সাবেক গভর্নর. বাংলাদেশ ব্যাংক), ড. আব্দুল বারী (এমবিই-লন্ডন), প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। মন্ত্রী পরিষদ সচিব, সিনিয়র সচিব, চট্রগ্রাম সিটি মেয়র, সেনাবাহিনী প্রধান, পুলিশের আইজিপি, ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এনজিও বিশেষজ্ঞ, কবি সাহিত্যিক, ব্যারিস্টারসহ অনেক ছাত্রছাত্রী সারা বিশ্বে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই চট্টগ্রামের বিদ্বৎসাহীগণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। ১৯৪০ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামবাদী চট্টগ্রামে একটি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন এবং আনোয়ারা উপজেলার দেয়াং পাহাড়ে ভূমিও ক্রয় করেন। ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়ে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে পূর্ব-পাকিস্তানের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার পর, ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামের বিদ্ব্যৎসাহী সমাজের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, প্রধান অতিথি ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেন।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে ৩০ ডিসেম্বর ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও স্মারকলিপি প্রদান, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬২ সালের ৯ ডিসেম্বর লালদিঘী ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধমঘট পালিত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষর স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন , তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও স্পিকার হিসেবে ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রীসভার বৈঠকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এ.টি.এম মোস্তফাকে পূর্ব-পাকিস্তানের তৃতীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামে স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ ফজলুল কাদের চোধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্ধ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান, ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান এবং ড. মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠন করেন। ১৯৬৪ সালের ১৭-১৯ জুলাই অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভাপতিত্বে ইসলামাবাদে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় ‘স্থান নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রকল্প-পরিচালক’ নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর এক সরকারি প্রজ্ঞাপন বলে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অফিসে বদলি করা হয়। ১৯৬৬সালে প্রফেসর ড. এ.আর মল্লিককে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আব্দুল মোনেম খান। প্রথমে কলা অনুষদের অন্তর্গত বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি বিভাগে ২০০ জন শিক্ষার্থী এবং ৭ জন শিক্ষক নিয়ে ১৯৬৬ সালের ২৮ নভেম্বর এম.এ প্রথমপর্ব (প্রিলিমিনারি) ক্লাস শুরু হয়।

১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন সকল ডিগ্রি কলেজকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা হয়। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান, বাণিজ্য, গনিত, পরিসংখ্যান, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা চালু করা হয়। ১৯৭০ সালে চালু হয় সমাজতত্ত্ব ও চারুকলা বিভাগ। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে ৩ বৎসরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞান অনুষদ এবং ১৯৭১ সালে সমাজবিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদ প্রতিষ্ঠিত হয়।বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদ- কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, সমাজবিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং , আইন ও জীববিজ্ঞান, ৬টি ইনস্টিটিউট- শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, চারুকলা ইন্সটিটিউট! ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারীজ, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, সমাজবিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ১টি অধিভুক্ত অনুষদ- চিকিৎসা অনুষদ; ২টি অধিভুক্ত ইনস্টিটিউট- ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফ থালমোলজি, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ এবং ২৫টি অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী (ভাটিয়ারী), বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী (পতেঙ্গা), বাংলাদেশ বন মহাবিদ্যালয় (ষোলশহর), চারুকলা কলেজ ও নেভাল একাডেমী (পতেঙ্গা)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর, এমবিবিএস, ডিভিএম, ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এছাড়া এম.ফিল, পিএইচ.ডি, এম.ডি এবং এমপি.এইচ উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাকর্মচারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় এর ভি.পি ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আব্দুর রব সহ ১৫ জন শহীদ হন। ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ইতিহাস পত্রিকা এবং অর্থনীতি বিভাগ থেকে ইকনমিক ইকো পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ৩ লক্ষের অধিক বই এবং ৫,৫০০ বিভিন্ন ধরণের পত্রপত্রিকা এবং ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ইতিহাস বিভাগের তত্তাবধানে পরিচালিত হয়। প্রাণীবিদ্যা বিভাগের যাদুঘরে ৫৪০ টি প্রাণীর নমুনা, সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের যাদুঘরে ৫৫০টি সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরে এতদঞ্চলের বহু পুরাকীর্তির সংরক্ষণ করা আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। ১৯৮১ সালে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববরেণ্য পদার্থবিদ ও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এর নামে একটি বিশেষ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন বিভাগের এলামনাই এসোসিয়েশন গঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগ ৫০ বছরপুতি অনুষ্ঠান (সুবর্ণ জয়ন্তী) পালন করেছে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র জাতীয় সংসদ সদস্য, মেয়র উপজেলা চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো ভিসি হিসেবে নিয়োজিত আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!