উপ-সম্পাদকীয়
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘযাত্রার ধকল সত্ত্বেও শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ সুস্থ ও সবল আছেন। এ তথ্যের সোর্স বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের। খালেদা জিয়া কবে নাগাদ রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন?- এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল বকীর রিজভী। তার ভাষায়: এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী। গুরুত্বপূর্ণ আরেক প্রশ্ন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফিরবেন কবে? –এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন লন্ডনে নিয়মিত তারেক রহমানের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি বর্তমানে ঢাকা অবস্থানকারী এম এ মালেক। জানালেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তার থাকার জন্য ঢাকায় ভাড়া বাসা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিএনপির হিতাকাঙ্খী মহল থেকে বলা হচ্ছে, দেশে ফেরার আগে তারেক রহমানের নিরাপত্তা ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, এখনো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ধারাবাহিক অপপ্রচার ও রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার তিনি। সমালোচিত ওয়ান-ইলেভেনে নির্মম নির্যাতিত তিনি। ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তারপর থেকেই তিনি সেখানে রয়েছেন। মাঝে কেটে গেছে ১৭টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাফল্যের সঙ্গে। শত ধকলের মাঝেও দলকে ইউনাইটেড রাখার ইতিহাস গড়েছেন। হেডম দেখানো শাহজাহান ওমর, তৈমুর আলম খন্দকার, উকিল আবদুস সাত্তার ধরনের কয়েকজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কেউ দল ছেড়ে যাননি। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে তারেক রহমানের ছিল দক্ষ নেতৃত্ব।
চিকিৎসা শেষে ৪ মাস পর দেশে ফিরেছেন খালেদা জিয়া। সাথে এসেছেন, তারেক রহমানের সহধর্মীনী জুবাইদা রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা। ঐক্যবদ্ধ বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে বলে যাবতীয় প্রস্তুতি দলের নেতাকর্মীদের। বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান এখন দল-মতের উর্ধ্বে। ঐক্যের ভিন্ন উচ্চতায় অবস্থান তার। যেই ছাপ দেখা গেছে লন্ডন থেকে তার রাজসিক ফিরে আসার মাঝেও। সেদিন ফুল-ব্যানার-ফেস্টুন আর শ্লোগানে শ্লোগানে খালেদা জিয়াকে পথে পথে শুভেচ্ছো জানিয়েছেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষও। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্ত হন বেগম খালেদা জিয়া ও পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান এবং সৈয়দা শামিলা রহমান। মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা আর আবেগের সম্মিলন ঘটেছে বিমান বন্দর থেকে গুলশানে বেগম জিয়ার বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত। বৈশাখের খরতাপের মধ্যেও রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন হাজারো নেতাকর্মী। চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তনে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মনে আস্থা বেড়েছে।
তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রাজনীতিতে আসবেন বলে একটি হাইপও রয়েছে। অরাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া জোবাইদার জীবনও চ্যালেঞ্জে ভরা। একজন চিকিৎসক, সংগ্রামী নারী এবং তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে দেখিয়েছেন কঠিন পরিস্থিতিতে মানবিকতা ও সাহসিকতার নিদর্শন। সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের মেয়ে জোবাইদার বাবা রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী বাংলাদেশের তৃতীয় নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক। জাতীয় জীবনে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে তাকে সমাজসেবায় ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী জোবাইদা রহমানের আপন চাচা। তার মেঝো চাচা আজমল আলী খান ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী। আরেক চাচা ডা. সেকেন্দার আলী খান। জোবাইদার দাদা আহমেদ আলী খান ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। ছিলেন আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, নিখিল ভারত আইন পরিষদ সদস্য এবং হায়দ্রাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টা। তার দাদী জোবাইদা খাতুন অবিভক্ত আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদার খান বাহাদুর ওয়াসি উদ্দিন আহমেদের মেয়ে। ডা. জোবাইদা রহমানের প্রপিতামহ ডা. খান বাহাদুর আজদার আলী খান বিহার ও আসাম মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আইরিন খানের চাচাতো বোন জোবাইদা ১৯৯৫ সালে চিকিৎসকদের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ডা. জোবাইদা রহমান লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন থেকে মেডিসিন বিভাগে অধ্যায়ন করে রেকর্ড নম্বর ও স্বর্ণপদক নিয়ে সম্মানজনক ‘এমএসসি’ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারেক রহমানের সাথে ১৯৯৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়া পরিবারের পুত্রবধূ হলেও জোবাইদা চিকিৎসা পেশা আগলে রেখেছেন। চিকিৎসকের পাশাপাশি তিনি একজন রাজনীতিবিদের স্ত্রীও। তারেক রহমান ও ডা. জোবাইদা রহমান দম্পতির একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার জায়মা রহমান। ছোটবেলা থেকে লন্ডনেই পড়াশোনা করেছেন তিনি। বিশ্বখ্যাত লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি পরবর্তীতে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী লিংকনস ইন থেকে ২০১৯ সালে বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেন। ২০০৭ সালে তারেক রহমান যখন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হন, তখন সাহসের সাথে পাশে দাঁড়িয়ে দক্ষতার সাথে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন জোবাইদা রহমান। পরিবারের দায়িত্ব, পেশাগত চাপ এবং সামাজিক দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তিনি যে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। হয়েছেন মামলার আসামীও। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকারের দায়ের করা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় ডা. জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে স্বামীর জেলমুক্তির পর শিক্ষাছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান তিনি। স্বামীর চিকিৎসা শেষ না হওয়ার কারণ দেখিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার ছুটি বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন ডা. জোবাইদা রহমান। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় ছুটি মঞ্জুর করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ অনুপস্থিত দেখিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
লন্ডনে প্রবাস জীবনে থেকেও তিনি পেশায় সচেষ্ট থেকেছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত স্বল্প মূল্যের রোগ নির্নায়ক কিট,খাদ্য সহায়তা, ওষুধ সহায়তাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে করোনা আক্রান্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য খন্ড খন্ড মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনায় জনস্বার্থে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তিনি মরহুম মাহবুব আলী ফাউন্ডেশন এবং সুরভী নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনস্বার্থে ব্যাপক অবদান রাখছেন। শাশুড়ির সঙ্গে দেশে ফিরেই অসুস্থ মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সাথে দেখা করেছেন তিনি। খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে কড়া নিরাপত্তায় একটি প্রাইভেটকারে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে যান জোবাইদা। সেখান থেকে যান যান ধানমণ্ডিতে মাহবুব ভবনে।
কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন এবং সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন খালেদা জিয়ার। তার চেয়েও বড় কথা তিনি লন্ডনে চারমাসের চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। আগেও চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার সঙ্গে তার এবারের ফেরার মধ্যে বিস্তর ভিন্নতা রয়েছে। দেশের রাজনীতি এবং জনগনের কাছে এর বিবেচনা অন্য রকমের। কেবল রাজনৈতিক কারণেই টানা গত ৬-৭টি বছর তার জিয়ার চিকিৎসা নিয়েও চলেছে ভোগান্তি। সঙ্গে অপমানসহ অপরাজনীতিও। বিএনপির অবিরাম আন্দোলনেও নিশ্চিত করা যায়নি তার বিদেশে চিকিংসা। সরকারের তরফে হাই-প্রোপাগান্ডা ছিল তার অসুস্থতা গুরুতর নয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুথানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর খালেদা জিয়ার বন্দি জীবনের অবসান হয়। চিকিৎসায় শারিরীকভাবে আগের চেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করায় দেশে ফেরেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাস্তবতা তাকে টেনে আনে দলের রাজনীতিতে। নেতাকর্মীদের আহ্বানে ধরতে হয় দলের হাল। ক্রমেই তিনি দল মাড়িয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ান। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয় তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া। ইচ্ছা ছিল স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকার। শেখ হাসিনা জেদ পূরণ করেছেন খালেদা জিয়াকে ওই বাড়িছাড়া করে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সব কটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তিপান। ওয়ান ইলেভেন সরকারের দায়ের করা বিতর্কিত এক মামলায় ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের সাজা দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। প্রথমে রাখা হয় পুরান ঢাকার পরিত্যাক্ত কারাগারে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে নেয়া হয় হাসপাতালে। সেদিনই সর্বশেষ গাড়ি থেকে হেঁটে নামতে দেখা যায় তাকে।
অনেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনকে রাজসিক বলতে চাইছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে, গণমানুষের নেতা গণমানুষের কাছে ফিরে এলেন। তবে খালেদা জিয়ার এবারের দেশে ফেরা ভিন্ন রকমের। তিনি দেশে ফেরার পর সামগ্রিকভাবে রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। দেশে আমাদের রাজনীতির আকাশে মাঝেমধ্যে অনিশ্চয়তার মেঘ এসে হানা দিচ্ছে। এখনো দেশে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। খালেদা জিয়ার প্রতি সকলের আস্থা এবং তার পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সেই মেঘ কেটে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
খালেদা জিয়া নিজেকে দলীয় গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেছেন। তিনি এখন শুধু বিএনপির নেতা নন, সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হয়েছেন। এই যে দলীয় সীমানার বাইরে গিয়ে সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হওয়া, এটাই খালেদা জিয়ার কৃতিত্ব। দেশে ফিরবেন শুনে দেশবাসীর আগ্রহ, আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করা—এটাই খালেদা জিয়ার অর্জন। এখানেই তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেলেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।