সোলায়মান ডালিম
গেল কিছুদিন কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যমের আচরণ দেখে মনে হলো বিষয়টি নিয়ে লেখা দরকার। বর্তমান সমাজে “সফলতা” শব্দটির সংজ্ঞা যেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও যখন আমরা সফল মানুষের উদাহরণ দিতাম, সেখানে থাকতেন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী কিংবা সৃজনশীল লেখক বা সংস্কৃতি কর্মীরা। আজ সেই জায়গা জুড়ে নিয়েছেন ইউটিউবার, টিকটকার এবং ফেসবুক কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। অবশ্যই সবার কথা এক নয়। কিন্তু যেভাবে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এখন ভিডিও বানিয়ে টাকা ইনকাম করা তরুণদের “আইডল” হিসেবে তুলে ধরছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা জরুরি।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজের প্রতিভা প্রকাশ করা কোনো খারাপ কাজ নয়। বরং প্রযুক্তির এই যুগে সেটাই তো স্বাভাবিক। অনেকেই সত্যিকারের প্রতিভা নিয়ে কাজ করছেন, সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়াচ্ছেন, জ্ঞান বিতরণ করছেন। কিন্তু গণমাধ্যম যখন তাদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় ওইসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের—যারা মূলত অপ্রাসঙ্গিক, ভাঁড়ামো নির্ভর, কিংবা ‘ভিউ’ বাড়ানোর জন্য যেকোনো সস্তা কৌশল অবলম্বন করে—তখন সেটা শুধু মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা নয়, বরং তরুণ সমাজের ভবিষ্যতের উপর এক অন্ধকার ছায়া ফেলে।
আজকাল মিডিয়ার অনেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “একজন তরুণ কীভাবে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ভিডিও বানিয়ে লক্ষ টাকা ইনকাম করলো”, বা “এই মেয়েটি পড়াশোনা না করেও এখন লাখপতি”, ইত্যাদি শিরোনামে প্রতিবেদনের ছড়াছড়ি। যেন সমাজের সবচেয়ে বড় অর্জন এখন এই যে, “কে কতো কম কষ্ট করে বেশি টাকা ইনকাম করতে পারছে!” শিক্ষার কোনো মূল্য নেই, মানসিক পরিশ্রম বা চরিত্র গঠনের কোনো গুরুত্ব নেই—এই বার্তাই কি আমরা তরুণদের দিতে চাই?
এই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে যখন তরুণরা ভাবতে শুরু করছে—“পড়াশোনার কী দরকার? ফেসবুকে ভিডিও বানিয়ে তো লাখ লাখ টাকা ইনকাম করা যায়!” এমনকি অভিভাবকরাও এই বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার বদলে, তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘স্টার’ বানানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। এতে করে পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মননশীলতা, হারিয়ে যাচ্ছে শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাস্তবতায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হওয়া উচিত ছিল? মূলধারার মিডিয়া কোনোভাবেই কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অবদান অস্বীকার করতে পারে না—তবে তাদের উপস্থাপনার ধরনে ভারসাম্য থাকা উচিত। যদি তারা ভিডিও বানানোকে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রচার করে, তাহলে তার পাশাপাশি ব্যাখ্যা করা উচিত—এই ক্ষেত্রেও প্রতিভা, মেধা, শৃঙ্খলা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। কারো আর্থিক সাফল্যের গল্প বলার পাশাপাশি তুলে ধরা উচিত, কেমন মানসিক চাপ, প্রতিযোগিতা এবং নৈতিক দ্বিধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন কনটেন্ট নির্মাতাকে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব আলোচনা গৌণ হয়ে গেছে। এখন মূল ফোকাস শুধুই টাকার অঙ্ক। যেই বেশি ইনকাম করছে, সে-ই “হিরো”। এতে করে আমাদের তরুণরা প্রেরণা নিচ্ছে একরকমের ভ্রান্ত ভাবনা থেকে—যেখানে সৃষ্টিশীলতা নয়, বরং মনোযোগ পাওয়ার জন্য যেকোনো কিছু করাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপর দিকে, ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের অ্যালগরিদমও এমনভাবে কাজ করে, যেটা দ্রুত মনোযোগ কেড়ে নেয় এমন কনটেন্টকে সামনে নিয়ে আসে। ফলে চিন্তাশীল, গবেষণাধর্মী বা শিক্ষামূলক কনটেন্ট অনেক সময়েই আড়ালে চলে যায়। মিডিয়া যখন এরই মধ্যে কাউকে ‘হিরো’ বানিয়ে দেয়, তখন সেই কনটেন্ট হাজারো তরুণের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠে। একটা প্রজন্ম যখন এই আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠে, তখন তার দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও বদলে যায়।
এটা ভাবনার বিষয়—এই যে তরুণরা ভিডিও বানানোকে “জীবনের একমাত্র লক্ষ্য” হিসেবে নিচ্ছে, তার পরিণতি কী হবে? একটা প্রজন্ম যদি শিক্ষা, গবেষণা, বা কোনো গঠনমূলক পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাহলে দশ বছর পরে আমরা কোন সমাজে বাস করবো? কে তৈরি করবে পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রযুক্তি বা সাহিত্যকর্ম?
এখানে মিডিয়ার আরেকটি দায়িত্ব হলো, সমাজের নানা ধরনের “সফলতা” তুলে ধরা। শিক্ষক, সমাজকর্মী, উদ্যোক্তা, বিজ্ঞানী কিংবা সাহসী পেশাজীবীদের গল্পগুলো বেশি করে প্রচার করা উচিত। যাতে তরুণরা বুঝতে পারে, টাকা ইনকাম করাই একমাত্র সাফল্য নয়। নৈতিকতা, মানবিকতা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতার সমন্বয় করেই একজন মানুষ সত্যিকারের সফল হতে পারে।
এছাড়া সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও চাইলে এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মিডিয়া শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার—যেখানে ছাত্ররা বুঝবে, কনটেন্ট নির্মাণ কিভাবে একটি পেশা হতে পারে, কিন্তু তার জন্য কী ধরণের প্রস্তুতি দরকার। একইসঙ্গে শেখানো উচিত—কীভাবে গঠনমূলক এবং দায়িত্বশীল কনটেন্ট তৈরি করা যায়।
সবশেষে বলা যায়, কনটেন্ট নির্মাণ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ইনকাম করা আপাদমস্তক খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সেটাকে “সবচেয়ে সহজ ও আকর্ষণীয়” সফলতার পথ হিসেবে উপস্থাপন করাটা চরম দায়িত্বহীনতা। মিডিয়া যদি সমাজের দর্পণ হয়, তাহলে তাদের উচিত সেই দর্পণে সমাজের ভারসাম্যপূর্ণ ও নৈতিক ছবি তুলে ধরা। নইলে আমরা শুধু একটি ভিউসর্বস্ব, সস্তা বিনোদনে মত্ত একটি সমাজই গড়ে তুলবো, যার ভিত থাকবে ঠুনকো ও নড়বড়ে।
লেখক : গণমাধ্যমেকর্মী।