বিশেষ প্রতিনিধি:
ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ১০৩টি ইটভাটার মধ্যে ৬০টিই অবৈধ।এরমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে জেলার দাগনভূঞা উপজেলার তুলাতুলি বাজার সংলগ্ন মেসার্স আর এল বি ব্রিকস-২ (বর্তমানে আরএলবি ব্রিকস স্টার) নামক অবৈধ একটি ইটভাটায় গত ১ জানুয়ারিতে প্রথম দফায়,২৩ মার্চ দ্বিতীয় দফায় এবং ৯ এপ্রিল তৃতীয় দফায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর,ফেনী জেলা কার্যক্রম এবং মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট উইং,পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর-ঢাকার যৌথ উদ্যোগে পরিচিত
সর্বশেষ এ অভিযানে বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট উইংয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজওয়ান-উল ইসলাম।
এ সময় ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আগুন নিভিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং ভেকু দিয়ে ধ্বংস করা হয় জেলার ফুলগাজী উপজেলার মেসার্স দেশ ব্রিকস, হাসানপুর ব্রিকস ও পরশুরাম উপজেলার সততা ব্রিকস নামক আরও ৩টি ইটভাটাও।অংশ নেন পরিবেশ অধিদফতর ফেনী জেলা কার্যালয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।
এর মাত্র একমাস না পেরুতেই ‘স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে মেসার্স আর এল বি ব্রিকস-২ (বর্তমানে আরএলবি ব্রিকস স্টার) ইটভাটায় চলেছে পুনঃ অবৈধ এ কর্মযজ্ঞ’।
এমনটি দাবি এলাকাবাসীর।তবে ভাটা মালিকদের ভয়ে এব্যাপারে নিজেদের নাম পরিচয় গোপন রাখতে এ প্রতিবেদককে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।
সরেজমিনে
দাগনভূঞা উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের তুলাতুলি বাজার সংলগ্ন ওই অবৈধ আরএলবি ব্রিকস স্টার ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়,ফসিল জমির মাটি পুড়িয়ে দেদারসে সেখানে চলছে ইট তৈরির কর্মযজ্ঞ।
এসময় ভাটাটির বর্তমান খরিদদার মালিক আব্দুর রহমান বলেন,সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুই মাসের জন্য মেনেজ করেই তিনি পুনরায় চুল্লীতে আগুন জ্বালিয়েছেন।ফলে এতে তার কোনো সমস্যা হবে না।
এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তর ফেনীর উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি’র মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও একাধিক সূত্রের অভিযোগ, বৈধ-অবৈধ এসব ইটভাটাগুলো শুধু উর্বর মাটি ধ্বংস করছে না, বায়ু, মাটি ও প্রকৃতির স্থায়ী ক্ষতি করছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের মালিকানা ও ছত্রছায়া এসব ইটভাটা চলছে। তাদের দাবি, প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখে অলিখিত চুক্তিতে ম্যানেজ করে এসব ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা। এসব ইটভাটার কারণে মরে যাচ্ছে আশ-পাশের গাছপালা। উর্বরতা হারাচ্ছে ফসলি জমি, ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ।
পরিবেশ অধিদপ্তর ফেনীর তথ্য মতে, জেলার ১০৩টি ইট ভাটার মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রপ্রাপ্ত বৈধ ইটভাটা ১৭টি, অবৈধ ১৬টি, ছাগলনাইয়া উপজেলায় বৈধ ৮টি অবৈধ ১০টি, পরশুরাম উপজেলায় বৈধ ২টি অবৈধ ৩টি, সোনাগাজী উপজেলায় বৈধ ৪টি অবৈধ ১টি, দাগনভূঞা উপজেলায় বৈধ ৮টি ও অবৈধ ১৬টি, ফুলগাজি উপজেলায় ৮টি বৈধ ও ১০টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
এসব ইটভাটায় যাচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি, অন্যদিকে বন উজাড় করে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে করে দূষিত কালো ধোঁয়ায় নষ্ট করছে আশপাশের পরিবেশ।
এদিকে ইটভাটাগুলোতে মানা হচ্ছে না সরকারের কোনো নিয়ম নীতি, প্রতিনিয়তই নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মাটি, বায়ু, কাঠ এবং ওজন স্তর। অভিযোগ রয়েছে কিছু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে প্রতিনিয়ত এসব ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন ও পরিবেশবাদীদের আপত্তির পরও ইটভাটাগুলোতে ফসলি জমির মাটি ও বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি হচ্ছে।
কৃষি জমির মাটি কাটার ফলে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা। ইটভাটায় মাটি নেওয়ার ফলে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের তৎপরতায় থেমে নেই ফসলি জমির উর্বর মাটি কাটা।
ফেনী সদর উপজেলার বিরলী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুছ ক্ষোভের সাথে জানান, ইটভাটায় ফসলি জমির উর্বর মাটি কেটে নেওয়ার ফলে কৃষি উৎপাদন দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধারে প্রভাবশালী মহল এসব মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে। কৃষি জমির অনেক মালিক নিজ ইচ্ছায় মাটি বিক্রি করতে না চাইলেও মাটি খেকোরা বিভিন্ন প্রলোভন ও চাপ সৃষ্টি করে এবং পাশের জমির মাটি কেটে বড় গর্ত করে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করছে।
ফেনী পরিবেশ ক্লাব অব ইয়ুথ নেটওয়ার্ক সভাপতি নজরুল বিন মাহমুদুল বলেন, ‘ইটভাটা দেশের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে তা কৃষি, জীববৈচিত্র ও প্রকৃতির ক্ষতি করছে। অধিকাংশ ইটভাটার কারণে কৃষিজমির ফসলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি আশপাশের বাসিন্দাদের নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ফেনী ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিবছর আমরা পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করি। কিন্তু নানা জটিলতায় তা হয় না।
এব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ইটভাটা গুটিয়ে ও বেশ কয়েকটিকে জরিমানা করা হয়েছে। যারা অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনা করছে এবং গুটিয়ে দেয়ার পরও কেউ পুনঃ চালু করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত,এরই মধ্যে বিগত ০৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা ও ফেনী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. শাওন শওকত অনিকের নেতৃত্বে একটি দল পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় অভিযান চালায়।
এ সময় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অমান্য করে ভাটা পরিচালনা করায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ সংশোধনীয় ২০১৯ এর বিভিন্ন ধারায় চারটি ইটভাটাকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
তাদের মধ্যে বিসমিল্লাহ ব্রিকসকে দুই লাখ টাকা, সততা ব্রিকসকে দুই লাখ টাকা, খণ্ডলহাই ব্রিকসকে ৫০ হাজার টাকা ও চিথলিয়া ব্রিকসকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর আগে ০২ জানুয়ারি দিনব্যাপী ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন, ফেনী সদর উপজেলা ও দাগনভূঞা উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় দাগনভূঞা উপজেলার তুলাতলি এলাকায় আরএলবি -১ ও -২ উচ্ছেদ করে। একই দিন সিরাজ ব্রিকফিল্ডে ছাড়পত্র না থাকা ও ফসলি জমির টপসয়েল কেটে মাটি সংগ্রহ করার অপরাধে ২০ লাখ ও দাগনভূঞা ব্রিকফিল্ডকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ।
অপরদিকে ধলিয়া ইউনিয়নের বালুয়া চৌমুহনী এলাকায় শুক্কুর ব্রিকফিল্ডে অভিযান চালিয়ে ছাড়পত্র না থাকায় ফসলি জমির টপসয়েল কেটে মাটি সংগ্রহ করার অপরাধে ১০ লাখ, কালিদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলায় অবস্থিত সোনাগাজী ব্রিকফিল্ডে ১০ লাখ টাকা গোবিন্দপুর এলাকায় তুষার ব্রিকফিল্ড উচ্ছেদে গিয়ে ছাড়পত্র না থাকায় ও টপসয়েল কেটে মাটি সংগ্রহ করার অপরাধের ৮ লাখ টাকা সহ ৫ টি ব্রিকফিল্ডে ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।