নিজস্ব প্রতিনিধি :
৫ আগস্টের পূর্বে ফেনী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রাবাসে শাসনের নামে ছাত্রদের শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন ছিল নিয়মিত ঘটনা। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের এহেন নির্যাতনের কথা ভয়ে বলার সাহস ছিল না কারও। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার পর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল র্যাগিংয়ের এই সংস্কৃতি। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে চিরচেনা সে সংস্কৃতি আবারো ফিরে এসেছে। এ নিয়ে আতঙ্কে ওই প্রতিষ্ঠানটির শাহাবুদ্দিন ছাত্রাবাসে থাকা নবীন শিক্ষার্থীরা।
গত ২১ মে বুধবার রাতে শাহাবুদ্দিন ছাত্রাবাসে মোহাম্মদ আদিব নামে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ১ম পর্বের এক ছাত্রের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ফেনী মডেল থানায় ও সদর উপজেলা প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এর আগে ২৭ এপ্রিল একই হলের ১০৩ নাম্বার রুমে ৫জনকে নিয়ে মারধর ও ১৮ ফেব্রুয়ারী গেস্টরুমে নিয়ে একসাথে ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করা হয়। সেখানে গেস্টরুমে (কমন রুমে) নিয়ে গিয়ে দুই হাত উপরে তুলে ও মাথা নিচু রেখে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ৫৫ ছাত্রকে। এ সময় বেশ কয়েকজনকে মারধরও করা হয়। এসব ঘটনায় ইনস্টিটিউট প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
শাহাবুদ্দিন ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা জানায়, জুনিয়রদের জন্য সিনিয়ররা ছাত্রাবাসে কিছু নিয়ম-নীতি তৈরি করেছে। লুঙ্গি পরা যাবে না, হাফ হাতার টি-শার্ট পরা যাবে না,পুকুরে গোসল করা যাবে না,দরজায় নক দেওয়া যাবে না, রুমে মশারি টাঙ্গিয়ে রাখা যাবে না ও ডাইনিং এ সিনিয়র-জুনিয়র এক কাতারে বসে খেতে পারবে না, জুনিয়রদের যায়গায় সিনিয়ররা বসলেও জুনিয়ররা বসতে পারবে না এবং সিনিয়রদের বেসিনংয়ে জুনিয়ররা হাত ধুতে পারবে না মর্মে নিয়ম করা হয়। এগুলা ভঙ্গ করলে জুনিয়রদের শাস্তি দেওয়া হয়।
বুধবার দুপুরে একজনকে ডাকতে গিয়ে দরজায় নক করে মোহাম্মদ আদিব। ভুল হয়েছে স্বীকার করার পরও এক ছেলে বড় ভাইকে বিচার দেয়।বড় ভাই পরিচয়ে ইলেকট্রনিকাল ডিপার্টমেন্টের ৫ম পর্বের শিক্ষার্থী শুভ দেব নাথ আদিবকে ডেকে গালিগালাজ ও মারধর করে।
মোহাম্মদ আদিব বলেন, “আমি নামাজের জন্য দুপুরে একজনকে ডাকতে গিয়ে জানালায় নক করি। সেখানে খ্রিস্টান উপজাতি এক ছাত্র রাগ করে। আমি ভুল স্বীকার করি। কিন্তু সে বড় ভাইকে বিচার দিবে বলে বিচার দেয়৷ বড় ভাই শুভ দেব নাথ রাত সাড়ে ৮ টায় আমাকে ডেকে গালাগালি ও মারধর করে। পরে আমি মডেল থানায় ও উপজেলা প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়ে থাকি।”
এর আগে ২৭ এপ্রিল রবিবার রাতে একই ছাত্রাবাসের ১০৩ নং হলে ৫ জন ছাত্রকে নিয়ে মারধর করা হয়। এ সময় সিনিয়রদের থেকে ৫ম পর্বের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক, ইফতেখার রহমান, ওয়াকিল আহমেদ, আব্দুল্লাহ নুর তুষার,মো. সাজিদ হোসেন ও কাজী আবু সাঈদ সিয়াম তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে।
নির্যাতিত একাধিক শিক্ষার্থী জানান, ১৮ ফেব্রুয়ারীর গেস্টরুমে নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন জনের পোস্টে রিয়েক্ট দেওয়ার ঘটনায় তাদের নির্যাতন করা হয়৷ এ সময় কয়েকজনে মারধর করা হয়।
এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারী ওই ছাত্রাবাসের কমন রুমে নিয়ে গিয়ে ৫৫ ছাত্রকে হাত উপরে তুলে ও মাথা নিচু করে রেখে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকজনকে নিয়ম ভঙ্গ করায় মারধরও করা হয়। পরে এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার সৃষ্টি হলে সেখানে রিয়েক্ট দেওয়া শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়।
বিষয়টি স্বীকার করে শাহাবুদ্দিন ছাত্রাবাসের হোস্টেল সুপার শ্রী নয়ন রঞ্জন ভট্টাচার্য ফেনীর সময়কে বলেন, “আমরা শুনেছি। এখানে সিনিয়রদের কিছু নিয়ম-কানুন সিনিয়ররা তৈরি করেছে। এগুলা না মানলে জুনিয়রদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। এখানে যে শুধু ওরা করে তা না, এখন জুনিয়র যারা আছে, তারা সিনিয়র হয়ে গেলে তারাও এ কাজ করে। পরে বিদায় নেওয়ার আগে ভয়ে ক্ষমাও চায়। আমি বিগত ২০ বছর এখানে আছি। ২০ বছরে এগুলা দেখে আসছি। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে আমাদের এ ক্যাম্পাসে এসব একেবারে কমে গেছে। নাই বললেই চলে। বুধবারের বিষয় শুনেছি। আমরা শিগগিরই এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবো। আমরা চাই না, এসব আবার ফিরে আসুক। আমাদের শিক্ষার্থীদের যাতে কিছু না হয় আমরা সেটাই চাই।”
অভিযুক্ত শুভ দেব নাথকে জিজ্ঞেস করা হলে সে ফেনীর সময়কে বলেন, “বুধবারের ঘটনা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হয়েছে। ওইদিন কিছুই হয়নি। ১৮ ফেব্রুয়ারী যেটা হইছে ও সময় হোস্টেল সুপারের নির্দেশে আমরা মনিটর করছিলাম। এটাই। ২৭ এপ্রিলের ঘটনার দিন আমি ছিলাম না।” আরেক অভিযুক্ত ওমর ফারুককে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা নাসরিন কান্তা ফেনীর সময়কে বলেন, “প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল মহোদয়ের সাথে কথা হয়েছে। তাকে ছাত্ররা এ বিষয় অবগত করেনি। আমি কথা বলেছি। ছাত্রদের সাথে বসে একটা সমাধান করতে বলেছি। প্রয়োজনে আমরাও হেল্প করবো বলেছি।”
ফেনী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ সামসুজ্জামান ফেনীর সময়কে বলেন, “এটা আমরা তদন্ত করতেছি। আমাদের কর্তব্যরত কর্মকর্তা প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথা বলেছে এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।”
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের নিকট জানতে চাওয়ার জন্য কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।