রুবলের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অনেকে নানা কারণ বিশ্লেষণ করছেন। মুদ্রাটি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ, ধারণা করা হচ্ছিল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি হয়তো ধসে যাবে।
রুবলের ঘুরে দাঁড়ানোর মূল কারণ হচ্ছে, রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি। অর্থাৎ গ্যাস ও তেল রপ্তানি। রুবলকে টেনে তোলার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপের দেশগুলো যে গ্যাস ও তেল কেনে সেটির মূল্য পরিশোধ করা হতো ইউরোতে। রাশিয়ার সঙ্গে এটাই ছিল তাদের চুক্তি। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া বলেছে যে তাদের কাছ থেকে যারা তেল গ্যাস ক্রয় করবে, সেটির মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে। এর ফলে ইউরোকে রুবলে পরিবর্তন করা হয়।
এ কারণে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হয়েছে। তা ছাড়া চীন এবং ভারতের কাছে জ্বালানি বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে। রাশিয়ার রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে ৬০ শতাংশই হচ্ছে গ্যাস এবং তেল। দেশটির রপ্তানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল।
গ্যাস ও তেল আমদানি বাবদ রাশিয়াকে প্রতিদিন ৪০ কোটি ইউরো পরিশোধ করে ইউরোপের দেশগুলো। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাতিয়ানা রোমানোভা বিবিসি বাংলাকে বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ কমেছে এ কথা ঠিক কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়া সেটি পুষিয়ে নিচ্ছে। তাতিয়ানা রোমানোভার বিশ্লেষণ হচ্ছে—পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে রুবলের চাহিদা ও জোগানের ওপর।
তাতিয়ানা রোমানোভা বলেন, রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে দেশটি অনেক জিনিস আমদানি করতে পারছে না এবং রাশিয়ার মানুষ আগের মতো বিদেশে যেতে পারছে না। ফলে তাদের ডলার ও ইউরোর চাহিদা কমে গেছে।
অন্যদিকে তেল-গ্যাস বিক্রি বাবদ অর্থ রুবলে রূপান্তর করে নেওয়ায় রাশিয়ার মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে। ফলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবল শক্তি ফিরে পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন তাতিয়ানা রোমানোভা। যেহেতু ইউরোকে রুবলে রূপান্তর করে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কিনতে হয়, সে জন্য রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে। এর ফলে রুবলের দামও বেড়েছে।
রাশিয়ার ভেতরে নানা পদক্ষেপ
এ ছাড়া রুবলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে রাশিয়ার সরকার দেশের ভেতরে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী রাশিয়ায় করপোরেট শেয়ার এবং সরকারি বন্ড কিনেছেন।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর তাঁরা সেগুলো বিক্রি করে দিতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা যাতে সেটি করতে না পারেন সে পদক্ষেপ নিয়েছে পুতিন সরকার। এর ফলে একদিকে যেমন রাশিয়ার স্টক ও বন্ড মার্কেটের পতন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে মুদ্রা দেশের বাইরে যেতে পারেনি। এসব কিছু রুবলের পতন ঠেকিয়েছে।
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। যাঁরা রুবল বিক্রি করে ডলার বা ইউরো কিনবেন না, অর্থাৎ রুবল সঞ্চয় করবেন, তাঁদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে।
রাশিয়ার অনেক কোম্পানি বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করে ডলার, ইউরো এবং ইয়েন আয় করছে। কিন্তু এখন রাশিয়ার কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসা করে যে আয় করবে, তার ৮০ শতাংশ রুবলে রূপান্তর করে নিতে হবে। এর ফলে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের একটি বড় চাহিদা তৈরি হয়েছে।
রাশিয়ার কোনো নাগরিক যাতে দেশের বাইরে অর্থ নিতে না পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে পুতিন সরকার। কারণ, দেশের বাইরে অর্থ পাঠাতে হলে সেটি ডলার বা ইউরোতে পাঠাতে হতো। সেটি বন্ধ করায় ডলার বা ইউরোর চাহিদা কমেছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ভেতরে থেকে গেছে। এটি রুবলের দরপতন ঠেকাতে সাহায্য করেছে।
তবে এ নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। তাতিয়ানা রোমানোভা বলেন, কোনো ব্যক্তি এখন চাইলে ১০ হাজার মার্কিন ডলার ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারবেন, কিন্তু এর বেশি পারবেন না।