কিশান মোশাররফ
বিবাহ একটি সামাজিক স্বীকৃতি। বিবাহ’কে পারিবারিক জীবনের সূচনা ও স্বীকৃত নারী-পুরুষের যৌন মিলনের নৈতিক সনদও বলেছেন সামাজিক বিশ্লেষকগণ। ধর্মীয় ভাবেও এর স্তুতি বর্ণনা করা হয়েছে। আবার কাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে কাদের সাথে যাবেনা ধর্মগ্রন্থ গুলোতে এর সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন ব্যাভিচার ও নৈতিকতার চুড়ান্ত স্খলন। ইংরেজিতে যেমন একটি প্রবাদ আছে ‘মানি লচ সামথিং লচ, ক্যারেকটার লচ ইজ এভরিথিং লচ’ অর্থাৎ অর্থ সম্পদ নষ্ট হলে বা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা সামান্যই বটে, যা চেষ্টা মেহনতের দ্বারা পুষিয়ে আনা যায় কিন্তু চারিত্রিক অধঃ পতন ঘটলে, ব্যাভিচারের হিংস্রতার কবলে নিমজ্জিত হলে তা থেকে ফিরে আসা দুস্কর। তাই চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলে মনুষ্যত্বের সবটাই ধ্বংস হয়ে যায়।
বিয়ে ইমানকে মজবুত ও খাঁটি করে তোলে। বিয়ে সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেন- “তোমাদের মধ্যে যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে তার দৃষ্টিকে নিম্নমুখী রাখতে সাহায্য করবে এবং তার লজ্জাস্থান রক্ষা করবে। বুখারী।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে এবং যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না, সে যেন ‘সাওম’ পালন করে। কেননা, সাওম যৌন ক্ষমতাকে দমন করে। সহীহ মুসলিম।
বিয়েতে মোহর একটি অপরিহার্য শর্ত, যা নারীর হক। মোহর আদায় করা পুরুষের জন্য ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।” [সূরা নিসা : আয়াত ৪] এই সূরার অপর আয়াতে বলা হয়েছে- অতএব তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ কর (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।-(সূরা নিসা : ২৪)।
অনেক বড় অংকের মোহর ধার্য করা যেমন শরীয়তে কাম্য নয় তেমনি তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া চাই, যা সম্মানের সাথে যথাযথ ভাবে ও শীঘ্রই পরিশোধ করা যায়। নবী (সা.) এর সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ রীতি এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস :
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান বলেন, আমি (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পরিমাণ মোহর দিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদেরকে সাড়ে বারো উকিয়া অর্থাৎ পাঁচশ’ দিরহাম মোহর দিয়েছেন।’ (সহীহ মুসলিম : ১৪২৬)।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে আমাদের মোহর ছিল দশ উকিয়া (চারশ’ দিরহাম), সুনানে নাসায়ী।
বর্তমানে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ে যেন হট্ট মেলা, জৌলুশ ছড়ানো রং তামাশায় পরিণত হয়ে গেছে। যত ঠাঁটবাট পয়সা ওয়ালা ততই রং তামাশার আয়োজন। গায়ে হলুদের নামে রংয়ে ডংয়ে কিশোরী, তরুনী সহ ললনাদের ডল নামে। চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো বোন সম্বন্ধীয়রা ছাড়াও মা, খালা, চাচী, ফুফুরাও বাদ যায়না গায়ে হলুদরের আনন্দ আয়োজনের নামে ভাড়া করা নৃত্য গীতের খেল তামাশা থেকে। জায়েয নাজায়েজের কোন বেদ বিচার থাকেনা। মাহরাম, গায়রে মাহরাম এসব নস্যি করে দিয়ে যে যায় সে-ই পাত্র অথবা পাত্রীকে হলুদ লাগানো, মিষ্টিমুখ করানো এবং ফটোসেশান করায় লিপ্ত হয়। এক সময়ের শহুরে এসব অপসংস্কৃতি এখন নিভৃত গ্রামকেও গ্রাস করেছে। কমিউনিটি সেন্টার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, নাটক থিয়েটারের ভেলকিবাজির আলোক সজ্জা পাড়াগাঁয়েও যেন ডাল ভাত। কোনো মুরব্বি এসব এড়িয়ে গেলে কিংবা এড়িয়ে যেতে চাইলে তার আর ঘরে বাইরে মুখ দেখাবার জো থাকেনা। অজস্র কথার বানে তাকে জর্জরিত হতে হয়। এমন হাঁড় কিপটের কিপটে একটু আনন্দ পূর্তির আয়োজন করলোনা। বিবাহ একজোড়া মানব মানবীর পবিত্র পারিবারিক সর্ম্পক স্থাপনের সূত্রারম্ভ কিন্তু এর সূচনা কার্যের প্রায় প্রতিটি পরতে পরতে গোমরাহি ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন লক্ষ্যনীয়।
বিবাহ পূর্ব পছন্দ অপছন্দ সবকিছু দেখাদেখি কথাবার্তার শেষ অংশে এসে ঝুলে পড়ে দেনমোহরের শর্ত। দেনমোহর যেন টাকার অংকে নারীর নিরাপত্তা কবজ হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেছে। আবার এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অভিভাবক পক্ষেও গৌরব ছড়ানো অহমিকা। ভ্রুু কুঁচকে চোখজোড়া কপালে তুলে এও বলাবলি করে ‘ওমুকের মেয়ের কাবিন এতো লক্ষ টাকা’। একের দেখাদেখি অপরের মধ্যে নীতিহীন নৈতিকাচার বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। অথচ রাসুল সাঃ হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন- তোমরা বিবাহকে কঠোর এবং কঠিন করিওনা। নবী করিম সাঃ পবিত্র কোরআনের একটি সূরাকেও দেনমোহর হিসেবে কার্যকর করে দেখিয়েছেন। তাঁর আপন কন্যা ফাতেমা রাঃ এর বিবাহ এবং তৎসম্বন্ধীয় আচার আনুষ্ঠানিকতা ‘মোহরে ফাতেমী’ নামে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণালি অধ্যায় হয়ে আছে।
মোহরানা নারীর হক কিন্তু সে হক পূর্ণ করনের সময় ও বাধ্যবাদকতার বিষয়ে অভিভাবকদের লোভ এবং উদাসিনতা আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে ঘাপেল করে তোলে। যেন বিয়েটা ঘটিয়ে দিতে পারলেই অনেক পূণ্য অর্জন করে ঘরে ফিরল। পাত্র তথা স্বামীর ঘাঁড়ে ভোজা চাপিয়ে দিয়ে অভিভাবক এবং মধ্যস্থতাকারীরা বিয়ের নামে রাশভারী দলিলের উৎসব রচনা করে চলেছে। এসব চল-চাতুরীর দ্বারা পূর্ন কামাচ্ছে না গুণাহে কাঁদ ভারি করছে সে হুশ আমাদের করোরই নাই।
আমাদের জরাগ্রস্থ মনোবিকার প্রসূত বিবাহ প্রস্তুতির শুরুতেই কুটিল চিন্তার রূপপরিগ্রহ করে। কাবিনের টাকার অংক যত বেশী হবে মেয়ের দাম্পত্য জীবন তত মজবুত এবং স্থায়ী হবে। এমন কথাও মুখ পসকে এসে যায়- যদি কখনো গন্ডগোল হয়, স্বামী-স্ত্রী’তে বিবাদ বিসম্বাদ তৈরী হয়, কাবিনের টাকা দিয়ে মেয়ে নিজেই কিছু একটা করে চলতে পারবে। আমরা আমাদের অজান্তেই কুফরি এবং শিরকি চিন্তায় পতিত হই। যে আল্লাহ আমাদের জীবন যাপনের নিরাপত্তা দানকারী, যে আল্লাহ আমাদের রিযিকের মালিক, মুহুর্তেই কাবিনের মাঝে রিযিকের নিরাপত্তা খুঁজতে শুরু করে দিই। আবার ছেলে পক্ষও কম যায়না। পাত্রী পছন্দ হওয়া এবং পাত্রী পক্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ফিটফাট ঝিকঝাক দেখে কাবিন বেশী হলেও কৌশল প্রয়োগ করে পীঁছু হটতে চায়না। বেশী অংকের কাবিন একটি যৌক্তিক যায়গায় স্থির রেখে উসুল (যেখানে থাকে সাজ-পোষাক, গহনা ইত্যাদি ক্রয়ের অতিরিক্ত মূল্য) বাড়িয়ে নেয়ার কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষই একটি মৌল সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই ধরনের চিত্র আমাদের সমাজের প্রায় সবগুলো বিবাহ সম্বন্ধীয় কাজ কারবারে দেখতে পাওয়া যায়।
ইমানের পরীক্ষা, জান্নাত তথা পরকালীন সুখ লাভের পরীক্ষায়তো আমরা এখানেই ফেল। যেখানে জীবনের বীজ বপনের সূত্রপাত সেখানেই আমাদের না শোকরী নাফরমানি চিন্তার বুদ। এসব চল-চাতুরী কর্ম পারতপক্ষে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
অধিক হারে ধায্য কাবিন মেয়ের সুরক্ষা কবজ না হয়ে বরং পারিবারিক অশান্তির বীজ তৈরি করতেই অধিকন্তু দেখতে পাওয়া যায়। পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপন ও বিবাহ বিচ্ছেদের হার বর্তমান সময়ে আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে। মোটা অঙ্কের কাবিনের ফাঁদে একই নারীর বহু বিবাহের ঘটনাও কম নয়। বর্তমান সময়ে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতায় ধর্মীয় ও সামাজিক শিষ্ঠাচারের রীতি রেওয়াজ চরমভাবে উপেক্ষিত। বিবাহ যে একটি পবিত্র কার্যসম্পাদনের কাজ। যার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যানের দীর্ঘ সূচনার ধারাপাত সেখানেই ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ উপেক্ষা করে নৃত্যগীত, হল্লাবাজী, আঁতশবাজিসহ বৈদিক রীতি রেওয়াজ সমাজে যেমন অস্থিরতা সৃষ্টি করে পারিবারিক জীবনেও অশান্তি আনয়ন করে। স্রষ্টার দয়া, অনুগ্রহ, বরকত ও রহমত প্রত্যাশার কোনো বালাই থাকেনা। কাজী, ধর্মীয় প্রতিনিধি তথা ইমাম সাহেবরা দাওয়াতে ভুরিবোজ ও নগদ হাদিয়ায় বরকত কামনা করা বিবাহ সংক্রান্ত উপলক্ষ্যকে নীচক রোজগারের অংশ বানিয়ে নিয়েছে। শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ডের দরুদ কোনো ইমাম, কোনো ধর্মীয় নেতা বিবাহ বর্জন করেছে এমন নজীর দেখতে পাওয়া যায়না।
পারিবারিক জীবনের বিশৃঙ্খলা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তাই পারিবারিক জীবনের সূচনায় নৈতিক ও শিষ্টাচার পূর্ণ আরম্ভের জন্য তাগিদদেয়া, মনোযোগ আকর্ষণ করা, ইহকালীন ও পরকালীন কল্যান কামনা ইত্যাদি শুদ্ধাচার বিশেষ প্রচার-প্রচারনায় ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভুমিকা রাখতে হবে।
বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা জৌলুশ দেখানো বা সৌন্দর্য প্রদর্শনের হাট নয়। নয় কোনো দৌলতি আজমতি মেহফিল। মানুষতো দুনিয়ার জমিনে ক্ষণিকের মুসাফির মাত্র। উত্তম মুসাফিরতো সে যে দুনিয়া কামানোর ফিকিরে মত্ত থাকেননা। মুসাফিরের জান মাল আল্লাহর রাহে উৎসর্গিত হবে এমন চিন্তা ফিকির আমাদের সকলের থাকা চাই। তাই বিবাহ’কে রঙ্গীন আচার আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না করে মিতব্যায়ী ও নবী মুহাম্মদ সাঃ এর সুন্নাহকে অনুসনণ করা হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।