দৈনিক ফেনীর সময়

জেলা পরিষদ কি জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয়?

জেলা পরিষদ কি জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয়?

আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যেই জেলা পরিষদের নির্বাচন শেষ করার পদক্ষেপ নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন। ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বাছাই ১৮ সেপ্টেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল আপিল দায়েরের সময় ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর, আপিল নিষ্পত্তি ২২ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৫ সেপ্টেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ২৬ সেপ্টেম্বর। আর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৭ অক্টোবর।

তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের বাকি ৬১টি জেলা পরিষদের মেয়াদ গত ১৭ এপ্রিলে শেষ হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল বিদায়ী চেয়ারম্যানদের নিজ নিজ জেলার পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হয় না।

এবারও ৬১ জেলায় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দাখিল হয়েছে ১৬২ জন, সংরক্ষিত আসনে ৭১৫ ও সাধারণ সদস্য পদে ১৯৮৩ জন। এ নির্বাচন নিয়ে কখনও নির্বাচনী শোরগোল তোলার চেষ্টাই দেখা যায় না। অবশ্য জেলা পরিষদ নির্বাচন উন্মুক্ত করে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা পর্বেও কখনও হয়নি। এ নির্বাচনে ভোটার যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা আর ৯০% জনপ্রতিনিধিই এখন আওয়ামী লীগের, সেক্ষেত্রে জেলা পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের ঘরেই আসবে এটাই স্বাভাবিক।
এর মাঝে বাড়তি কথায় এক চিমটা লবণের মতো ল্যাঠায় কাঁঠালের আঠা লাগিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। জেলা পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন গ্রহণের সময় বলে বসেছেন, আওয়ামী লীগ থাকলে আর কিছু লাগে না। বিএনপি-জামায়াত-জাপাসহ সব বিরোধীদলেরও উচিৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিানাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য দোয়া করা। তাহলে এ দলগুলোও নিরাপদে থাকবে। কী বলতে গিয়ে তিনি কী বললেন! রীতিমতো আচানক-আজগুবি কথা।

এ ধরনের জেলা প্রশাসকরাই হবেন আগামী সংসদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা। কী নির্বাচন করবেন তারা- প্রশ্নটি রাজনীতির বাজারকে আগাম দিয়ে দিয়েছেন। এর মাঝে আগুনে ঘি ঢেলেছেন জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। নির্বাচনে ছেলেখেলার চেয়েও খেলো করে দিয়ে এরইমধ্যে অনেকেই জিতে গেছেন বিনাভোটেই।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগটা বরবাদ করেছে আগেই। তাদের দলীয় সাংগঠনিক কাঠামোতে শৃঙ্খলা ঝালাই বা চর্চার সুযোগও এখন আর নেই।

স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেয়া এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে আরও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে এইচ এম এরশাদ আমলে গঠিত জেলা পরিষদে সংসদ সদস্যরাই দায়িত্ব পালন করতেন। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করে। এরপর জোট সরকারের আমলে এনিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করে। এরপর প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর।

স্থানীয় এই সরকারের মেয়াদ আরো আগেই শেষ হলেও আইন সংশোধনসহ অন্যান্য জটিলতার কারণে ভোটগ্রহণ্র করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। আইনটি সংশোধনের পর গত ১৭ এপ্রিল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রশাসক বসানোর কথা বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়- দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ায় নির্বাচিত পরিষদগুলো বিলুপ্ত করা হলো।

এ অবস্থায় জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের আগে প্রত্যেক জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি যোগ করে জেলা পরিষদ আইনের সংশোধনী পাস হয় গত ৬ এপ্রিল। আইন সংশোধনীর গেজেট প্রকাশ হয় ১৩ এপ্রিল।

আগের আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জেলার অধীনে যতগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর সদস্যরাই জেলা পরিষদ সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতেন। অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র এবং কাউন্সিলররা বা সদস্যরা ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত করতেন। কিন্তু সংশোধিত আইনে জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলার উপজেলার সংখ্যার সমান। আর নারী সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলার উপজেলা চেয়ারম্যানদের মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, তবে দুই জনের কম নয়। অর্থাৎ একেক জেলা পরিষদের সদস্যের সংখ্যা হবে একেক রকম। সংশোধনের আগে যেটা ২১ জন নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়ে ছিল।

জনপ্রতিনিধিরা শুধু ভোটই দিতে পারবেন, প্রার্থী হতে পারবেন না। আর বাংলাদেশের ২৫ বছর বয়সি যেকোনো ভোটার জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারলেও ভোট দিতে পারবেন না।

দেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সে সময় তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলায় নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ২১টি জেলায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন। এছাড়া নির্বাচনে ৬৯ জন সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য এবং ১৬৬ জন সাধারণ সদস্যও বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা শপথ নেন ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি আর সদস্যরা শপথ নেন ১৮ জানুয়ারি।

সমালোচকরা বলেন, আইয়ুব খান স্টাইলে এ পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি আর পুনর্বাসনের জেলা পরিষদ জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। কিছুই না করে খেয়ে মোটাতাজা হওয়ার এ জেলা পরিষদই এখন সমালোচিত বিষয় হয়ে গেল। এটি পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বৃদ্ধনিবাস নামায়নে চলে গেছে এরইমধ্যে। এটি রাখারই দরকার আছে কি-না, এ প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। হাতে ধরে এ ধরনের প্রশ্নের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের টিপ্পনির সুযোগ না দেয়ার ফুসরত না দেয়া যেতো। কারণ আইন অনুযায়ী জেলা চেয়ারম্যানদের কাজ একদম কম নয়। জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ ১২ ধরনের বাধ্যতামূলক কাজ করে জেলা পরিষদ। এছাড়া সাতটি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দও কম নয়। এর বাইরেও ক্ষমতাসীন দলে বাড়তি কিছু চিন্তা ছিল এ ধরনের মনোনয়নের পেছনে অতি বেড়ে যাওয়া নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের কৌশলে নিয়ন্ত্রণ, দমন বা সামলানোর কৌশল ছিল। আওয়ামী লীগের সংগঠনিক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তত ৪০ জেলাই কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। এসব জেলায় আওয়ামী লীগের চেয়ে এমপিলীগ বেশি পরাক্রমশালী। কোথাও কোথাও এমপি বা তার স্বজন-নিকটজনরা হাতও তুলছেন দলের কর্মীদের গায়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত আট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা এ সংক্রান্ত তালিকাসহ রিপোর্ট দিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে। এর বাইরে কারো কারো বিরুদ্ধে হিন্দু সম্পত্তি দখল, সীমান্তে চোরাকারবার, মাদক পাচারসহ জঘন্য নানান কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

কেবল প্রতিপক্ষ নয়, দলীয় লোকজনকেও নয়; শিক্ষক-সরকারি কর্মচারী পেটানোর রেকর্ডও গড়েছেন এ তালিকার এমপিদের কয়েকজন। তাদের অনেকেরই এখন ইমেজ খারাপ। না সাধারণ মানুষ, না দলীয় নেতা-কর্মী কোথাও অবস্থান নেই। কারো কারো দলে বড় পদ নেই। কিন্তু, ক্ষমতার প্রভাব বলয় তৈরি করে এমপি লীগ তৈরি করে টিকে থাকতে চাইছেন তারা। তাদের কেউ কেউ ছিলেন গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেকর্ড সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর নেপথ্য মদদদাতা। উপজেলা ও পৌর নির্বাচনেও তাই। তাদের অনুসারীরা যেখানেই নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি সেখানেই বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের সুক্ষ চেষ্টার অংশ হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে জেলা পরিষদকে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দ ব্যাপক। এর প্রশাসকদের কাজের আওতাও কম নয়।
এ অবস্থায় বেশ ভেবেচিন্তে ৬০ এর মধ্যে ৩১টি জেলায় এবার নতুন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নানা কারণে বঞ্চিত ও পেছনে পড়ে থাকাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে। মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে ‘বঞ্চিত ও নিগৃহীত’ হিসেবে পরিচিত। তাদের ৬০ জনের মধ্যে ২৫ জনই ৭০ বছর বয়সী। ৮০ বছরের বেশি বয়সী রয়েছেন ৫ জন। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সময় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের পক্ষে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড বা পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’- ধরনের প্রবাদ-প্রবচন দেয়া হলেও কয়েক জেলায় তাদের নিয়ে সমালোচনা উসকে দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই বয়স্কদের পক্ষে কাজের চাপ সামলানো কঠিন হবে।তাদের দিয়ে হবে কেবল বয়স্ক পুনর্বাসন। দলে অবস্থান শক্ত না থাকার পরও এমপির আস্থাভাজনদের স্কুল, কলেজ, মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটিতে আধিপত্য, উন্নয়নমূলক কাজে খবরদারির মাঝে তারা কতোটা পেরে উঠবেন- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
জনপ্রতিনিধি কেবল সুবিধা অর্জনের উপায় নয়, বরং একটি সম্মানের বিষয়- এই বোধটা যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!