গত পহেলা অক্টোবর ২০২২ পালন হয়ে গেলো ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতি বছর নতুন নতুন থিম বা প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঘটা করে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘ কর্তৃক এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির প্রতি সহনশীলতা।’ অর্থ্যাৎ প্রবীণদের প্রতি সহনশীল হওয়া বা সহনশীল আচরণ করা সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব বা কর্তব্য। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবীণদের প্রতি এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়।
জরা বা বার্ধক্য জীবনের এক চরম সত্য। শৈশবের সোনালি সকাল শেষ করে, তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে, মাঝ বয়সের ব্যস্ত বিকেলটাও যখন চলে যায়, তখনই জীবন সায়াহ্নের গোধূলী বেলা হয়ে আসে বার্ধক্য। এই সময়টা আসলে মানব জীবনের শেষ অধ্যায়। নেহায়েত অকালমৃত্যু না হলে এই স্তরটিতে শেষ পর্যন্ত পদার্পণ করতেই হবে। বার্ধক্য তাই জীবনের নিয়তি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য এই পাঁচটি স্তরের জীবন চক্রের সর্বশেষ ধাপ বা পরিণতি হলো বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব। মানব জীবনে বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা। বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক পরিবর্তন ছাড়াও বৃদ্ধদের শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধিও দানা বাঁধে। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্কদেরই হয়ে থাকে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষসাধনের ফলে আমাদের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে। ১৯২১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল যেখানে ২০ বছর, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগেরও বেশি প্রবীণ। অর্থাৎ প্রবীণের সংখ্যা ৮০ কোটিরও বেশি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি, এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে প্রবীণসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি হবে। এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন।
এমতবস্থায় প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, কর্মঅক্ষমতা, পরিবার হতে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের কল্যাণের জন্য প্রবীণবিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ক) ১৯৩৮ সালে রাশিয়ায় বার্ধক্য নিয়ে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। খ) ১৯৬৫ ও ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের কিছু কিছু আলোচনায় বার্ধক্য এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। গ) ১৯৮২ সালের অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রবীণ বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা (Vienna International Plan of Action on Ageing (VIPAA) গৃহীত হয়। দিকনির্দেশনায় ১৪টি মূলনীতির আলোকে প্রবীণদের কল্যাণ বিধানের লক্ষ্যে ৬২টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ঘ) ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় প্রতি বছর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর প্রবীণদের সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদায় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হয়। ঙ) ১৯৯৪ সালে কায়রোতে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বয়স্ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। চ) ২০০২ সালে বিশ্বের ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে প্রবীণ বিষয়ক ২য় বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে একটি সুসংবদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয় যা ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা’ (Madrid International Plan of Action on Ageing) হিসাবে পরিচিত। উক্ত আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়- (১) সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন। (২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন। (৩) নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন। (৪) জীবনব্যাপি এবং শেষ জীবনেও স্বচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। (৫) প্রবীণরা কোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয়-বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ। (৬) প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। (৭) জেন্ডারকেন্দ্রীক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার। (৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান। (৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা। (১০) প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা। (১১) উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান। (১২) আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারির্পাশ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়া। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণায় যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ: (ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন। (খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি। (গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এছাড়াও সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
প্রবীণদের দৈনন্দিন জীবন যাপন স্বাচ্ছন্দ্যময় করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং তাঁদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদেরকে সচেতন করাসহ নানাবিধ জটিল সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য ১২ সেপ্টেন্বর, ২০১৪ সনে ঢাকায় প্রথমে বাংলাদেশ জেরিয়াটিক সোসাইটি পরে ২০১৮ সনে নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ভিওিক কাজ শুরু করে। প্রবীণদের বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে যাচ্ছেন। প্রবীণদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি একটি অরাজনৈতিক, সেবামূলক ও অলাভজনক জনকল্যাণমূলক সামাজিক সংগঠন। এই সোসাইটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাতীসংঘের প্রস্তাব অনুসারে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবীণদের সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সোসাইটি দেশের সকল প্রবীণকে একটি পতাকাতলে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে অধিকাংশ প্রবীণরা অবনতিশীল স্বাস্থ্য, আর্থিক দীনতা এবং সামাজিক নিরাপওাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। তাই, প্রবীণদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এবং এনজিওসহ জনকল্যাণমূলক সংগঠনগুলোকেও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যম তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সনে বয়ষ্ক ভাতা চালু করলেও বার্ষিক বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই অপ্রতুল বা নগণ্য। তাছাড়া বয়স্কভাতার তালিকায় নিম্ন ও হতদরিদ্র শ্রেণির প্রবীণরা ছাড়া অন্যরা এর অন্তর্ভুক্ত না। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পরিবার ও সমাজে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। প্রবীণ বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা-২০১৩ অনুমোদন ও পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন এবং ২০১৪ সনে ৬০ উর্ধ্ব প্রবীণদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করলেও এখনো অনেক প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। তাই নিম্নলিখিত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তাব আকারে পেশ করা হলো- ১) পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে প্রবীণদের জন্য বিদ্যমান আইন অনুসরণে প্রবীণ বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা এবং ভরণ-পোষণ আইন সংস্কার, সময়োপযোগী, উন্নত এবং আধুনিক করা। ২) মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বেড ও কেবিন সংরক্ষণসহ কনশেসন রেটে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা এবং একইভাবে কনসেশন রেটে ফার্মেসি হতে ওষুধ ও পথ্য সামগ্রী পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা। ৩) আর্থিক সমস্যা বিবেচনায় এনে গণপরিবহনে (সড়ক, রেল, স্টীমার এবং বিমানপথ) তাদের জন্য আসন সংরক্ষণসহ কনসেশন রেটে টিকেট এর ব্যবস্থা করা। ৪) বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উর্ধ্বগতি বিবেচনায় শুধুমাত্র সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সল্পমূল্যে রেশনিং সিস্টেম চালু করা। ৫) আর্থিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকে তাদের জন্য হেলপ ডেস্ক এবং পৃথক পৃথক কাউন্টার রাখার ব্যবস্থা করা। ৬) বিভিন্ন সঞ্চয়ী স্কীম বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র স্কীমে, পুজিবাজারে, এবং সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিভিন্ন প্রকার বন্ড ও লাভজনক প্রকল্পে উচ্চতর হারে বিনিয়োগের সুযোগ প্রবর্তন করা। ৭) সিনিয়র সিটিজেনদের কল্যাণে ‘প্রবীণ কল্যাণ সঞ্চয়পএ’ প্রবর্তনসহ প্রবীণ ওয়েলফেয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। ৮) সার্কিট হাউজ, ডাক বাংলা, পর্যটন মোটেল এবং বেসরকারি হোটেল-রিসোর্টে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৯) আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে আহুত সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আচার অনুষ্ঠানে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে আমন্ত্রণ জানানোসহ তাদের আসন সংরক্ষণ এবং তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন ও মর্যাদা প্রদানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১০) জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা, দুর্যোগে সিনিয়র সিটিজেনদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিমালা প্রবর্তন করা। সরকারি ও বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ট্রেনিং সেন্টারে রিসোর্স পারসন অথবা অতিথি বক্তা হিসেবে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা করা। ১১) ইমিগ্রেশন, পাসপোর্ট প্রাপ্তি, ভিসা প্রাপ্তি, জাতীয় গুরুত্ব সনদপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সিনিয়র সিটিজেনদেরকে অগ্রাধিকার/ বিশেষ বিবেচনায় গণ্য করা। ১২) সরকার কর্তৃক সিনিয়র সিটিজেনদেরকে পৃথক স্মার্ট কার্ড অথবা পরিচয়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা। ১৩) পেশা ভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে তাদেরকে কাজে লাগানো। ১৪) গণমাধ্যমসমূহ তথা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সামাজিক আন্দোলন ও শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবীণদের জীবনের বিভিন্ন দিক, পরিচর্যা, সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। ১৫) শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বার্ধক্য ইস্যুটি অন্তর্ভূক্ত করা।
১৬) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন- মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদিতে সাপ্তাহিক ধর্মীয় বিশেষ দিনে ওয়াজ মাহফিলে প্রবীণদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। ১৭) পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সন্তানকে সচেতন করার জন্য ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ানোর ব্যবস্থা করা। ১৮) পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলায় সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা। ১৯) অন্যান্য দিবসের মত গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও স্কুলে প্রবীণ দিবস পালন করা।
পরিশেষে আমি বলতে চাই- প্রবীনদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হয়েছি। আমাদের সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়েছে এই প্রবীণ মানুষগুলোর পরিশ্রমে, তাদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তায়। তাদের আত্ম-উৎসর্গিত জীবনের চরম সুবিধাভোগী আমরাই। প্রবীণদের জীবনকাল বিসর্জনের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই আধুনিক উন্নতমানের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। প্রবীণরা হলো এই সুন্দর জীবন ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার রচিয়তা। তাদের প্রতি কোন বৈষম্য নয়, কোন করুণা নয় কোন অবহেলা নয়। আইনের ভয়ে নয় বরং প্রদর্শন করতে হবে নৈতিক, আদর্শিক ও ধার্মিক মহা প্রতিদান। তারাই আমাদের জীবনের শত প্রেরণার নিরন্তন উৎস, জীবন্ত কিংবদন্তি। একজন সক্ষম মানুষ তার জীবনের পুরোটা সময় শেষ করে দেয় যে পরিবারের জন্য, জীবনের শেষ সময়ে সেই পরিবারে থাকাটা তার নৈতিক অধিকার। আর এই অধিকার হলো আল্লাহ প্রদত্ত। এটা তাদের প্রতি কোন দয়া নয়। কোন অনুগ্রহ নয়। সুতরাং পরিবারই হচ্ছে প্রবীণদের আসল ঠিকানা। তাদের ঠিকানা কোনভাবেই বৃদ্ধাশ্রম হতে পারে না। প্রবীণদের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ, প্রবীণদের এই সমস্যা সমাধান না হলে আগামীতে ভুক্তভোগী হবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মই। প্রবীণদের জীবন যেন সত্যিকার অর্থেই হয় আনন্দের, শান্তিময়, মধুর স্মৃতিময়। তারা যেন নিজেদের অবহেলিত, পরিবারের ও সমাজের বোঝা মনে না করেন। পরিবারই যেন হয় প্রতিটি প্রবীণের নিজ আবাস, এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।