সোলায়মান হাজারী ডালিম:
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে জাতি। দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ একসাথে হাজির হয়েছে। এ সংকটকালীন সময়ে প্রয়োজন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকর ভূমিকা এবং জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ।
স্বৈরাচারী শাসনের পরিণতি:
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দমন, বিচার বিভাগের উপর প্রভাব খাটানো, বিরোধী দল দমনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার এবং নির্বাচন ব্যবস্থার বিকৃতি ইত্যাদি অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব কারণে গণতন্ত্র চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, জনমনে গভীর হতাশা এবং ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। সরকারের পতনের পর এই ক্ষোভ ও হতাশা যেন নতুন সংকটের জন্ম না দেয়, সে জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও কাঠামো:
চলমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল লক্ষ্য হবে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিরপেক্ষতার পথে ফিরিয়ে আনা। এই সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন হবে না; বরং বিশিষ্ট নাগরিক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, যাতে করে কমিশন প্রকৃত অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি, বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করা, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রে সংস্কার আনা, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে সরকারের মূল কর্মসূচির অংশ।
জাতীয় ঐক্যমতের প্রয়োজনীয়তা:
শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের রাজনীতি গভীর বিভক্তির মুখে পড়েছে। একপক্ষ অপর পক্ষকে অবৈধ, বিশ্বাসঘাতক বা দেশবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে আসছে। এই বিভক্তি দূর না হলে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ভিত্তি তৈরি সম্ভব নয়। এজন্য দরকার জাতীয় ঐক্যমত।
জাতীয় ঐক্যমত গঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় ও পেশাজীবী সংগঠন, তরুণ প্রজন্ম এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে একটি সমঝোতা গড়ে তুলতে হবে। এই ঐক্যমতের ভিত্তিতে জাতীয় চার্টার তৈরি হতে পারে, যেখানে আগামী ১০ বছরের জন্য মৌলিক রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণ করা হবে—যেমন স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।
সংস্কার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহ:
১. নির্বাচনী ব্যবস্থা: ইভিএম ব্যবহারের বিতর্ক, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ সব অনিয়ম দূর করতে একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বস্ত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
২. গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশ: ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ সকল দমনমূলক আইন বাতিল করে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রশাসনিক কাঠামো: দলীয়করণমুক্ত, দক্ষ ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা জরুরি।
৪. দলগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা: রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা: বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করে একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামোতে আনা প্রয়োজন।
উপসংহার:
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর এ সুযোগকে কাজে লাগাতে না পারলে, হয়তো জাতি আরেকটি স্বৈরাচারের মুখে পড়বে। তাই এখনই সময় জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি নতুন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পথে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার। এই পথ অবশ্যই সহজ নয়, তবে জনগণের ইচ্ছাশক্তি ও ঐক্য থাকলে সেই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত অর্জন সম্ভব।
_-লেখক- গণমাধ্যম কর্মী।