মো: মাঈন উদ্দীন :
দেশকে যারা ভালোবাসে না, দেশের সম্পদের প্রতি যাদের দরদ নেই, দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে তারা টেকসই করবে? সাজানো জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করা উন্নয়ন, অর্থনীতির সূচকগুলো নিয়ে প্রতারণা করে জনগনের নিকট উন্নয়নে বিশাল ফিরিস্তি দেখিয়ে জনগনের সাথে প্রতারণা করে ও জনগনকে বোকা মনে করে মিলিয়ন, বিলিয়ন টাকা পাচার, লুটপাট দেশের জন্য একটি বড় ধরনে কলঙ্ক। রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগনের আস্থা কিভাবে, কতটুকু থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতিতে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দেশ থেকে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রতি বছর পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এসব অর্থ পাচার হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন- ‘এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর দশায় আমরা পেয়েছি, তা এ রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতি এ নথি থেকে উপকৃত হবে।’ অর্থপাচার, মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি, ব্যাংক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি , শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনিযম ও লুটপাট সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। শ্বেতপত্রের পর্যালোচনায় দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট ও জনপরিসরে দুর্দশার বিষয়গুলো উঠে আসে। এতে বলা হয়, দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রতারণামূলক তথ্য, শিথিল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বেপরোয়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি অর্থায়নে লুণ্ঠন এবং বহিঃখাতের ভারসাম্যহীনতা অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষত যতটা সন্দেহ করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর বলে শ্বেতপত্র প্রণয়নকারীদের পরিচালিত তদন্তে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রেখেছে সাজানো জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করা উন্নয়ন আখ্যানের মাধ্যমে। যদিও ফুলানো-ফাঁপানো উন্নয়ন কাহিনী, স্থবির কর-জিডিপি অনুপাত, বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত এবং সামাজিক সুরক্ষাসহ মানব উন্নয়ন খাতে সম্পদের ঘাটতিকে আড়াল করতে পারেনি। শ্বেতপত্র প্রণয়নকারীদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের ডাটা ইকো-সিস্টেম মূলত রাজনৈতিক পছন্দ অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছে।
এতে উঠে আসে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রয়কৃত পণ্য ও সেবায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ থেকে ঘুস হিসেবেই চলে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুস নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগী ব্যক্তিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুসের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। আর রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সহযোগী ব্যক্তিদের কাছে গেছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা গেছে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে। ঘুসের বেশির ভাগই দেয়া হয়েছে নগদ অর্থে কিংবা অন্য কোনো জিনিস উপঢৌকন হিসেবে।
মূলত সরকারি তহবিল থেকে গত ১৫ বছরে দেশে বাস্তবায়িত বড় প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ঋণও ছিল। এভাবে প্রকল্প করার কারণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ এখন ১৫৫ বিলিয়ন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। শ্বেতপত্রে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল ব্যাংক খাত ও এখাতের অর্থপাচার ও লুটপাটের চিত্র। এতে দেশের ব্যাংক খাত গভীর কৃষ্ণগহ্বরে নিমজ্জিত বলে উল্লেখ করা হয়। শ্বেতপত্রে বলা হয়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতির ৩১ দশমিক ৭০ শতাংশই ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। ওই সময় খেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ মিলিয়ে দেশের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। শ্বেত পত্রে উঠে এসেছে ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিটিতে অতিরিক্ত ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে। এ সময়ে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর ১০ শতাংশ অবৈধ লেনদেন ধরা হলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার।
শ্বেতপত্রে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তা হল অর্থনীতি বিষয়ক কিছু চিত্র। কিন্তু পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানুষের বাকস্বাধীনতা সহ সার্বিক পরিস্থিতি যে আরো কত ভয়াবহ ছিল তা এদেশের জনগণই তার সাক্ষী। এখন প্রশ্ন হল আগামীতে আমরা কি কেউ চাই এধরনের শ্বেত পত্র আবারও ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদের জন্যও করা হবে, নিশ্চয় না। তাই আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি সুন্দর , টেকসই, কল্যাণমূলক, জবাবদিহিতামূলক, বৈষম্যহীন সমাজ। যেখানে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে , দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশের সম্পদের সুরক্ষা করে, মানুষের জানমালের হেফাজত করে সুশাসন ও শৃঙ্খলার সাথে চলতে পারি।
অর্থপাচার কারী, প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। এহেন অপরাধীদের অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার না করলে শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে। পতিত স্বৈরশাসকের ফেলে রাখা অর্থনীতির দৈন্যদশা থেকে উত্তরণের জন্য চ্যালেঞ্জ সমূহকে মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগোতে হবে। বর্তমানে যেসব সমস্যা, অনিয়ম, প্রতারণা ও অর্থ লোপাটের চিত্র ফুটে উঠেছে এসবের বিরুদ্ধে স্বৈরশাসকের ভয়ে অনেকেই তখন মুখ খোলেননি। এখন সময় এসেছে দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি দেশপ্রেম ও দেশের সম্পদ সুরক্ষারকে সামনে রেখে করতে হবে। এটা সকলের নিকট পরিষ্কার যে রাষ্ট্রীয় মদদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতর জন্য আর্থিক খাতের ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তাই শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করতে হবে। বেড়ায় খেত যেন না খায়। ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যালেন্সসিট ও রেটিং এজেন্সির আরো স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুন:তফসিল সুবিধার ঋণগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়। সেখান থেকে ৩১.৭ শতাংশ বেড়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৬ হাজার ০৩০ কোটি টাকায়। প্রতিববেদনে আরো বলা হয় স্বীকৃত মন্দ ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। পুন:তফসিলকৃত ঋণ ২ লাখ ৭২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৭৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৩৯ হাজার ২০৯ কোটি এবং আদালতের স্থগিতাদেশে আটকা ঋণের পরিমাণ ৭৬ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেখা-অদেখা ঋণে ব্যাংকিং খাত ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হবে। আমানতকারীদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেব। আমানতের সুরক্ষা দেওয়া হবে।’ শ্বেতপত্রে উল্লেখিত চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সমূহ আমলে নিয়ে আগামীর পথচলা সকলের জন্য যেন শস্তিদায়ক ও প্রশান্তির হয়। এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।