সজল কান্তি বণিক :
ন্যানোটেকনোলজি হলো এমন বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি যা পরিচালিত হয় ন্যানো স্কেলে, যেটি ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার আকৃতির কোনো কিছু তৈরি করা হলে, তাকে সাধারণভাবে ন্যানোপার্টিকেল বলে। এ প্রযুক্তি মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে ভাঙ্গিয়ে বা জোড়া লাগিয়ে আগামী দিনে অনেক কিছু করা সম্ভব।
‘ন্যানো’ শব্দটি গ্রিক ন্যানোস থেকে এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ বামন বা জাদুকর ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী।
আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর তার “There’s Plenty of Room at the Bottom” আলোচনায় ন্যানোটেকনোলজি সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন। যদি একটি মার্বেল এক ন্যানোমিটার হয়, তাহলে পৃথিবীর সাইজ হবে এক মিটার। ন্যানোসায়েন্স ও ন্যানোটেকনোলজি হলো একক অণু-পরমাণু দেখা এবং নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য। ন্যানো প্রযুক্তির ফলে কোনো উপকরণকে এতটাই ক্ষুদ্র করে তৈরি করা যায় যে, এর থেকে আর ক্ষুদ্র করা সম্ভব নয়। এ পৃথিবীর সব কিছু যা আমরা খাই, যা আমরা পরি, ঘরবাড়ি যাতে আমরা বাস করি, আমাদের দেহের সবকিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত, কিš‘ পরমাণু এতো ছোটা ছোট যে খালি চোখে তা দেখা যায় না। ১৯৮০ সনে ওইগ এর গবেষকরা প্রথম আবিষ্কার করেন এসটিএম (Seanning Tunneling Microscope) এ যন্ত্রটি দিয়ে অণুর গঠন পর্যন্ত দেখা সম্ভব। এ যন্ত্রটির আবিষ্কারই ন্যানো প্রযুক্তিকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। এতে ছোট-খাটো একটা পিঁপড়াকে মনে হবে একটি ডাইনোসর। ক্ষুদ্র আকৃতির জন্য ন্যানোপার্টিকেলের পৃষ্ঠদেশ বা সারফেসের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বিধায় রাসায়নিকভাবে এটি অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। পাশাপাশি ন্যানো পার্টিকেল তৈরি হলে এর ভেতরে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করে। ন্যানোপার্টিক্যাল ও ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
হৃদপিণ্ডের ধমনীর ব্লক নির্ণয়ে ন্যানোপার্টিক্যাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ন্যানো-রোবট ব্যবহার করে অপারেশন করা সরাসরি রোগাক্রান্ত সেলে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। নিকেল ন্যানোপার্টিক্যাল ও পলিমার সহযোগে কৃত্রিম চামড়া তৈরির মাধ্যমে প্লাস্টিক সার্জারিতে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিয়েশন দিলে আক্রান্ত কোষ ছাড়া আশেপাশের আরও অনেক ভালো কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ন্যানো প্রযুক্তি দ্বারা রেডিও তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে আক্রান্ত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স, খাদ্য প্যাকেজিং, ক্লথিং, ফুয়েল ক্যাটালিস্ট, গৃহ-সামগ্রী ঔষধ, খাদ্য সংরক্ষণ, বায়ু শোধন, জীবাণুমুক্ত পানি সরবরাহ ইত্যাদিতে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১১ এর মার্চে এক সমীক্ষায় প্রায় ১৩০০ আইটেমের ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার দেখা গেছে।
কম্পিউটারের প্রসেসরের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ন্যানোমিটার স্কেলের সার্কিট। ইন্টেল প্রসেসর সিলিকন এর ওপর প্যাটার্ণ করে যে সার্কিট বানানো হয় তার বর্তমান সাইজ হলো ৩০ ন্যানোমিটার। ভবিষ্যতে আরো ছোটো সাইজে নিয়ে আসলে প্রসেসর এর আকার অনেক ছোটো হয়ে আসবে। এছাড়া কম্পিউটারের হার্ডডিস্কেও ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজি। এখন বাজারে টেরাবাইটের হার্ডডিস্ক পাওয়া যাচ্ছে।
খাদ্য উপাদানে রং টেক্সার ও স্বাদ বৃদ্ধিতে খাদ্যশিল্পে এখন ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে। ন্যানোস্কেল খাদ্য উপাদান উৎপাদন করা হচ্ছে, যা খাদ্যের রং টেক্সার ও স্বাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। খাদ্য প্যাকেজিং এ দীর্ঘকাল ধরে ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বায়ুশোধনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মোটরযান ও শিল্পকারখানা হতে নির্গত কালো বিষাক্ত ধোঁয়াকে পরিশোধিত করে বর্জ্য উপাদানকে অপসারিত করে নির্মল বায়ুতে পরিণত করতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার অতুলনীয়। পরিবেশ সুরক্ষায় ভূগর্ভস্ত পানি কার্বন টেট্রাক্লোরাইড দ্বারা কোনোভাবে দূষিত হলে আয়রণ অক্সাইডের ন্যানোপার্টিক্যাল ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে নতুন ধরনের ফুড প্যাকেজিং সিস্টেম তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যেখানে প্যাকেজিং এর জন্য ন্যানোসেন্সর ব্যবহৃত হবে। নতুন ধরনের প্লাস্টিকের ফ্লিম তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে যার মধ্যে খাদ্য দীর্ঘদিন সতেজ থাকবে।
ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বৃহৎ স্কেলে পণ্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে এবং উৎপাদিত পণ্য আকারে সূক্ষ্ম ও ছোটো হলেও অত্যন্ত মজবুত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী, টেকসই ও হালকা হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আগামীতে দূরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্তি, প্রতিরক্ষায় ন্যানো রোবট, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিশ্বব্যাপী বৃহৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ, কার্যকরী ও সস্তায় শক্তি উৎপাদনসহ পানি ও বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তাই বলা যায়, আগামী বিশ^ হবে ন্যানোটেকনোলজির বিশ্ব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফেনী সাউথ-ইস্ট কলেজ।