নাসির উদ্দিন বাহার এডভোকেট
৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারের হত্যার পর ইতিহাসের ২য় কলঙ্কজনক অধ্যায় জেল হত্যা দিবস। মানবতা ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে ৩ নভেম্বর একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৭৫ এর ১৫ইং আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার কিছুদিন পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম কামরুজ্জমানকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতার শত্রæরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্জন প্রকোষ্টে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর জেল হত্যা। ষড়যন্ত্রকারীরা এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চেতনা ধ্বংস ও জাতিকে নেতৃত্বহীন কারার গভীর অপচেষ্টা করেছে। জাতীয় ০৪ নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধ সুহৃদ। মৃত্যুও সে বন্ধন চিহ্ন করতে পারে নাই। তারা তাদের নেতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বিশ্বাসঘাতকতা করেননি মা, মাটি, মানুষ, ও মাতৃভূমি স্বাধীনতার সঙ্গে। অথচ সময়টা ছিল চরম বিশ্বাসঘাতকতার। বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয়ের বটবৃক্ষ ছায়া যারা হৃষ্টপুষ্ট হয়েছিলেন তাদের অনেকে সেদিন নাম লেখিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতকতায়, ব্যতিক্রম ০৪টি মানুষ দু’বার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। একবার একাত্তরে আবার পঁচাত্তরে।
কিন্তু মুহুর্তের জন্য মথানত করেননি তাঁরা, বিচ্যুত হননি নেতার প্রতি নিন্ঠা এবং নীতি আদর্শ থেকে। জাতীয় নেতা তাজ উদ্দিন আহমেদ তার সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন এদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। খুবই কঠিন একটি সময় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শিরোধার্য্য করে পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বত্তে¡ও যাপন করেছেন আনাড়ম্বর জীবন। অটেল সুযোগ থাকা স্বত্তে¡ও নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য গড়ে তোলেননি সম্পদের পাহাড়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকেরা তার বাসায় গিয়ে তাকে মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ঘাতকেরা প্রস্তাব গ্রহণ করলে তিনিও বেঁচে যেতেন। কিন্তু সকল প্রলোভন ও ভীতি আগ্রহ্য করে তিনি ছিলেন অবিচল-তাঁর আদর্শ নীতি ও নেতার প্রতি নিষ্ঠার প্রশ্নে। একাত্তরের তো বটেই, পঁচাত্তরেও। জীবন দিয়েছিলেন কিন্তু নীতি নিষ্ঠার ও আদর্শের পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেননি কখনোই।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যিনি প্রবাসী সরকাররের ভারপ্রাপ্ত রাষ্টপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম (১৯৫২ কিশোরগঞ্জে), তাজউদ্দিন আহম্মদ ছিলেন বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার সন্তান, এএইচ.এম.কামরুজ্জামান (১৯২৬ এং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর জন্ম রাজশাহীর সিরাজগঞ্জে। অথচ কি অদ্ভুত মিল তাঁদের মধ্যে। একমাত্র ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (১৯১৭) ছাড়া বাকী ০৩ জনেরই জন্ম বিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বয়সের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০) সমসাময়িকী বলা চলে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের জাতাকলে পিষ্ঠ সে সময়ের রাজনৈতিক চরিত্রতা বিস্মৃত হলে চলবে না, তাঁরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, ছাত্রজীবনে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে, আমৃতু সে রাজনীতিকে শিরোধার্য্য করেছেন- যে রাজনীতির প্রথম ও শেষ কথা ছিল মানুষের কল্যাণ সাধন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন পাকিস্তানী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মিলটি হল, আওয়ামীলীগের সূচনালগ্নের কর্মী সংগঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ঝঞ্জামুখর রাজনৈতিক জীবনের একনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন তাঁরা, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ও সুহৃদ। মৃত্যুও সে বন্ধন ছিন্ন করতে পারেননি। কারাগারের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরাসরি রাষ্ট বা সরকারের উপর ন্যস্ত। অথচ কারাগারের ভেতরে অসহায়ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল জাতীয় ৪ নেতাকে, রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষ আসীন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ নির্দেশে। দীর্ঘ ২৫ বছর এই হত্যাকান্ডের তদন্ত পর্যন্ত হতে দেওয়া হয়নি। একটি জাতির ইতিহাসে বছর বছর মুক্তিযুদ্ধ হয় না। শতাব্দীতে এরকম মাহেন্দ্রক্ষণ হয়ত একবারই আসে।
মহান সেই মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হলো। হত্যার নির্দেশদাতা ও ঘাতকেরা শুধু বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াল না, বন্দুকের জোরে হলেন রাষ্ট্রের দন্ডমুÐের কর্তাও। সেনা ছাউনিতে বসে রাজনৈতিক দল গঠন করা হলো। উর্দি পরেই রাতারাতি রাজনৈতিক নেতাও বনে গেলেন কেউ কেউ। সেসব দলের নেতারা সাফাই গাইলেন যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও জেল হত্যার সঙ্গে তাদের কোন সংশ্রব নেই। কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করবে কেন? এই দলগুলো যখন ক্ষমতায়, তখন ঘাতকেরা সরকারি চাকরি পেল, পদোন্নতি পেল। আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে আখ্যায়িত করা হলো জাতির সূর্য সন্তান হিসেবে। আর বছরের পর বছর বাংলাদেশের মানুষকে কী দেখতে হয়নি ভন্ডামির দৃশ্য? জেল হত্যাই ঘাতকদের প্রথম অপরাধ নয়। এই হত্যাকান্ডের মাত্র ৭৯ দিন আগে তারা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বর্বরতার নতুন দৃষ্টান্ত ¯’াপন করেছেন। তারা হত্যা করেছেন আমাদের স্বাধীনতার মহান ¯’পতি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, ১০ বছরের শিশু রাসেল এবং গর্ভবতী নারীরাও রক্ষা পাইনি। তাদের বর্বরতা থেকে। একই দিনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ০২ বীর সেনানি শেখ ফজলুল হক মনি ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ তাদের পরিবারের অনেককে। নারী শিশু তো ছিলই, সেসব পরিবারে বেড়াতে আনা ব্যক্তিরাও স্বীকার হয়েছেন এই তান্ডবের।
এরকম বর্বরতার নজির পৃথিবীতে খুব বেশি খুঁজে পাওয়াযাবে কি? বঙ্গবন্ধুর ও জাতীয় ০৪ নেতার ঘাতদের স্বসম্মানে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সু-ব্যব¯’া করা হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আকর্ষনীয় বেতনে চাকরী দিয়েছিলেন সে সরকার যারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতার রক্ত মাড়িয়ে সামরিক পোষাক পরে ক্ষমতায় এসে দল গঠন করেছিল, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া সরকার বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও জেল হত্যার খুনিদের ভিবিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরুষ্কিত করেছিলেন। খন্দকার মোস্তাকের জারিকৃত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়াউর রহমান ৭৯ জাতীয় সংসদে দায়মুক্তি আইন পাস করে হত্যাকারীদের সাংবিধানিকভাবে এই মর্মে সুরক্ষা দেওয়া হলো যে, বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কোন বিচার করা যাবে না, ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তভূক্ত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তারপর ও নানা চড়াই উত্তরাই পার হয়ে জেল হত্যার খুনীরা বিচার মুখেমুখি হয়েছে, দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছে, দন্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে আমারা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন এম.মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম কামরুজামানকে স্বরণ করি। তাঁরা বাংলা মায়ের কৃতি সন্তান, তাঁদের অবদান চির অ¤øান, তাঁরাই বাঙ্গালির ইতিহাসের স্রষ্টা। তাদের রক্তের স্রোত ধারায় সিক্ত বাংলাদেশ নানা চড়ায় উৎরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী দেশরতœ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু, জেলহত্যা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘৃর্ণ খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করে ইতিহাসের অসাধ্য সাধন করে বাঙালি জাতিকে অভিশাপের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে খুনিদের পেতাত্তা ও আশ্রয়-পশ্রয় দানকারীরা দেশী ও আন্তজার্তিক চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশকে আবারও পুরোনো পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদাায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলে পুরনো শকুনদের পরাস্ত করতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি
সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগ।