দৈনিক ফেনীর সময়

আপনিইতো বাংলাদেশ

আপনিইতো বাংলাদেশ

এডভোকেট নাসির উদ্দিন বাহার :

১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের গঠনার সময় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন ব্রাসেলসে। বেদনাভরা প্রবাস জীবন শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৭ মে ১৯৮১। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ই মে থেকে দেশে ফিরলেন তা যেন বাংলাদেশ নির্বাসন থেকে অস্তিত্বে ফিরল। ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের সমার্থক করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের সমার্থক এই জন্য যে, ৭৫ বঙ্গন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ চিন্তাই হয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক হয়ে। তাঁর প্রমাণ কবি হাসান হাফিজুর শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, “আপনিইতো বাংলাদেশ”।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান বাঙ্গালিকে তাঁর হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রদান করেছেন, তাঁরই কণ্যা দেশরত্ন শেখহাসিনা কর্তৃক সে রাষ্ট্রটি আজ বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত। তাঁরই শাসনকাল ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালের মত আজ থেকে ৫০০ বছর পরেও বাঙালির ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে স্বরণীয় হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার শাসনকালে বাঙালির বিশ্বসভায় উন্নত মস্তকে দাঁড়াতে পেরেছে। বাঙালির জন্য তাঁর ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সেই রাষ্ট্রটিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তিনি যে রাষ্ট্রটি পেয়েছিলেন সেটি ছিল পাকিস্তান সৈন্য কর্তৃক বর্ণানাতিতভাবে বিধ্বস্ত এক দেশ, প্রতিটি খাতে নিঃস্ব এক রাষ্ট্র- কৃষিতে, শিল্পে এমনকি সেবাখাতেও এই বিধ্বস্ত রাষ্ট্রটিকে তিনি সাড়ে তিন বছরের মধ্যে পুনঃ নির্মাণ করেছিলেন রাজনৈতিক কাঠামোয়- ১০ মাসের মধ্যে বাঙালির ১ম সংবিধান রচিত হয়েছিল। পরিকল্পিত পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক কাঠামো, ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। ১৯৭৫ সালের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে নিয়ে যান, বাংলাদেশের কৃষিতে করেন প্রায় স্বংয়ম্ভর শিল্পের ক্ষেত্রেও ৭৩-৭৪ এ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮% যা পরবর্তী ৮ বছরের কোন আর্থিক বছরেই অর্জন করা সম্ভব হয়নি, তিনি বেঁচে থাকলে সম্ভব দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছত। এই রাষ্ট্রটিকে তিনি কিভাবে পুর্নগঠন করতে ছেয়েছিলেন, কিভাবে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, প্রতিটি বাঙালির জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা সাংস্কৃতিমনা জীবন চেয়েছিল। তা তাঁর সাড়ে তিন বছর ব্যাপি শাসনকালের ভিবিন্ন প্রয়াশের মধ্যে সুষ্পষ্ট হয়ে উঠে।

বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়ানের পর বাংলাদেশের ইতিহাস পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু একটি সাম্য ভিত্তিক, অম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভিত্তি তৈরি করেছিলেন, পরবর্তী ২১ বছরে বাংলাদেশ তা থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। সামরিক ফরমানের মাধ্যমে পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক ও শোষণ ভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করা হয়। ৭৫ উত্তর শাসকেরা স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মত একটি বিশাল অপরাধকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়। ‘৭৫-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস একই সঙ্গে গভীর বেদনা ও বেদনাকে জয় করে বিজয়ের ইতিহাস। এই বিজয়ের এবং বাঙালির পুনরুজ্জীবনের হোতা জাতির জনকের কণ্যা শেখহাসিনা।

প্রায় দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সমাপ্ত করে শেখ হাসিনা যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন আওয়ামীলীগের সভাপতি হয়ে, তখন এই দেশে সামরিক ও আধা সামরিক রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিষ্টিত। তিনি এদেশে ফিরে এসেছেন গণতন্ত্রের বহ্নিশিখা হিসেবে। তাকে দেশে ফিরে প্রায় দশক ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। দেড় দশকের সংগ্রাম শেষে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে প্রথম বারের মতো আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনতে পেরেছিলেন এবং সে সময় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে ফেরেছিল। প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ উন্নিত করেছেন। মূল্য স্ফীতির হার সর্বনিম্নে রাখতে ফেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাংবিধানিক বাঁধা দূর করতে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কৃষি যন্ত্রপাতি ও আধুনিক উপকরণ বিতরণের মাধ্যমে সর্বোচ্ছ খাদ্য শশ্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। বৃদ্ধভাতা চালু করে সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করেছিলেন। ধর্মোম্মদনাসহ পাক-জিন্দাবাদ সংস্কৃতির বিকাশ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এত সব সাফল্যের চেতনায় পাকিস্তানি সংস্কৃতির ধারক প্রক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ভীত-চকিত, সামরিক অসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ২০০১সালে আওয়ামীলীগকে নির্বাচনের মাঠে কোণঠাসা করে ক্ষমতাচুত্য করার মধ্য দিয়ে একাত্তরের পরাজিত জিন্নশক্তি ক্ষমতার অংশীদার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক নজীর স্থাপন করেন। ২০০১ সালের অক্টোবরের পর থেকে রাজনৈতিক নির্যাতন, হত্যা ভিন্ন ধর্মালম্বীদের উপর আক্রমণ ঘরবাড়ী দখল, ধর্ষণ, দূর্নিতিতে চ্যাম্পিয়ন, ক্ষমতাসীন বিএনপি জামাতের আশকারায় সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের উত্থান, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলায় সরকারী পৃষ্টপোষকতা, বাংলাদেশের ভূ-খন্ডকে বিদেশী সন্ত্রাশীদের অস্ত্র চালানের রূট হিসেবে ব্যবহার এবং তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে হস্তগত করে ক্ষমতা ধরে রাখার মত সীমাহীন নাক্কারজনক প্রচেষ্টা, সেসব দুঃসহ দিন কাটিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভূমিধষ বিজয়ে ৬ই জানুয়ারি ২০০৯ ২য় বারের মতো শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ নির্বাচনী ইস্তেহারে দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রূপকল্প ২০২১ উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশ জন্মজয়ন্তী উৎসবের আগেই মধ্যম আয়ের দেশ হবে, খাদ্য উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, প্রবৃদ্ধির হার ২০১৫ সালের মধ্যে ৭% শতাংশে অর্জিত হবে, প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার শতভাগ উন্নিত হবে। বাংলাদেশের জন্মজয়ন্তীর বছরের মধ্যেই ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে। রূপকল্প ২০২১ ঘোষণার মধ্যদিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে পরিকল্পনার আলোকে তৈরি ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা, যেগুলো ছিল অতীতের পরিকল্পনাগুলো যদি ভিন্নত বাংলাদেশের ১ম পঞ্চবার্ষিকির পরিকল্পনাকালে মোট বিনিয়োগের ৮৭ শতাংশ। আর বেরকারী বিনিয়োগ ছিল ১৩ শতাংশ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনাকালে বে-সরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৭ শতাংশ আর সরকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশ। পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এক উল্লম্ফন। দূরদৃষ্টিতে লক্ষ্য-অভীষ্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধু কণ্যা এগুলেন, রচিত হলো নয়া জাতীয় পরিকল্পনা একের পর এক। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র দূরীকরণ মানব সম্পদ সৃষ্টি, সড়ক জনপথ সৃষ্টি, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা তাও বাস্তবায়িত হলো, গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি গ্রাম সংযুক্ত হলো সড়ক যোগাযোগ। সেবা পেতে শহর-গ্রাম ব্যবধান প্রায় একাকার হলো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও দক্ষিন এশিয়ার সবদেশকে বিস্মিত করে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিন এশিয়ার সব দেশকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে প্রণয়ন করেছে দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প ২০৪১ কে ধারন করে রচিত হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পথচিত্র। বাংলাদেশ বিশ্ববাসির চোখে এখন এক অদম্য বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজের গুরুদায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখহাসিনা।

বাংলাদেশ পাকিস্থানের উপনিবেশ ছিল ২৪ বছর শোষণ নির্যাতন জর্জরিত ছিল বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতাকালে পাকিস্তানীরা বাঙালীদের ছেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি ধনী ছিল, আর এখন বাঙালিরা তাদের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি। বঙ্গবন্ধু কন্যা গত একযুগের স্বর্ণালী শাসনকালের দক্ষিন এশিয়ায় নব উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাড়িয়েছে ২০২৩৮ ডলার, গড় আয়ুস্কাল ৭৩, বয়স্ক শিক্ষার হার ৭৫, বিদ্যুৎ সংযোগের হার ৯৯, শিশু মৃত্যুর হার ২৬, পতি নারির সন্তান জন্মহার ২, আর্থসামাজিক প্রায় প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এগিয়ে। গত একযুগের এই স্বর্ণ সফলতা বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার সাহসী, দৃঢ়চিত্ত, বুদ্দিমত্তা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের ফলে অর্জিত হয়েছে। দেশের অর্থে পদ্ম সেতু তৈরির ঘোষণা ও তার দৃশ্যমান হওয়া তাকে করেছে দূর্জয় বাঙালী অজেয় অনমনীয় সাহসিকতার প্রতীক। বাংলাদেশের একযুগের অগ্রযাত্রা, সমুদ্রের বিজয় সহ আঞ্চলিক ভারসাম্য পূর্ন কূটনীতি বিশ্ব পরিমন্ডলে ডজনের অধিক অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তী, বিশ্ব নেতাদের সম্পর্কে ভালো সম্পর্কের কারণে এক মহান ষ্টেটসম্যান ও বিশ^নেত্রী হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বিশ^সেরা ১০০ চিন্তাবিধের ১ম সারির দিকে অন্তভূক্ত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা শ্রেণীতে এক দশকের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ বিশে^র ১০০ ক্ষতমতাধর নারীর তালিকায় সম্মূখসারিতে এবং বিশে^র দ্বিতীয় সেরা প্রাধানমন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছেন। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরি বাংলাদেশ পেয়েছে। যেমন বঙ্গবন্ধু তেমনি শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের জন্য মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ, জয় বাংলা।

লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগ।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!